[ রচনাটি সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এর দ্বিতীয় বর্ষ ৫ম সংখ্যা, তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০২৫-এ প্রকাশ হয়েছিল ]
মাতৃভাষা বাংলা, রাজনীতি ও বাংলাদেশ
পৃথিবীতে কত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে? বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় বসবাসকারীরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলাদেশসহ দুনিয়ার প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির মুখের ভাষা এটি। বিভিন্ন পুস্তকে লেখা হয়েছে যে বাংলাভাষার শুরুটা খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ৫০০০ বছরেরও পিছনে। বহু ভাষাবিদ বলেছেন, বাংলাভাষা খুঁজে পাওয়া যায় খৃস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। তবে কিংবদন্তি বলে, বাংলাভাষা সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মত ইন্দো আর্য ভাষা থেকে এসেছে।
ইন্দো আর্য হলো ইন্দো ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার একটি ধরন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও উক্ত মতে বিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, মধ্য ইন্দো আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, সেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং খেরাবাদ বৌদ্ধ কাননের শিলা লিপিতে। অতঃপর কালক্রমে এই অপভ্রংশ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম হয় বাংলাভাষার ।
পুরাতন বাংলা ছিল ৬৫০ খৃষ্টাব্দে বাংলার পুরোহিত ও পন্ডিতদের সাহিত্যকর্মের ভাষা। সবচেয়ে প্রাচীনতম বাংলার নিদর্শন পাওয়া যায় নেপালে। একমাত্র চর্যাপদ নামক কবিতার সংকলনে- যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। তখন কিন্তু রাজভাষা হিসেবে সংস্কৃতই প্রধান ছিল ।
সালতানাত যুগ পার হওয়ার পর ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করে। সেই সময় বাংলা ভাষার যোগাযোগ ঘটে ফার্সি ভাষার সঙ্গে।
কালক্রমে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরপরই লক্ষ্য করা গেল বাংলা নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষা হিসেবে প্রচলিত ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার আধুনিক রূপের ভিত্তি গড়ে উঠলো মাগধী, প্রাকৃত, পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণে। উক্ত ভাষাগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে। এটাই হলো আধুনিক বাংলা ভাষার বিবর্তন।
বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ ঘাটলে দেখা যায় যে, প্রায় ৭৫,০০০ পৃথক শব্দ রয়েছে, যার ক) ৫০,০০০ শব্দ তৎসম, সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি গৃহীত। কিন্তু ড. শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেছেন যে, তৎসম শব্দগুলি আসলে প্রাকৃত ভাষা থেকে এসেছে, সংস্কৃত থেকে নয়। কিন্তু অজানা কারণে ব্যাকরণ বই লেখা বা ছাপানোর সময় তৎসম শব্দগুলি সংস্কৃত থেকে এসেছে বলা হয়। এটা ঠিক নয়। এবং খ) ২১০০০ শব্দ তদ্ভব, বাংলা ভাষার শব্দ সমূহ, যার উৎস পালি ও প্রাকৃত ভাষা দ্বারা হয়েছে এবং গ) আর অন্যান্য ভাষা থেকে প্রায় ৫০০০ বিদেশি শব্দ বাংলায় ঢুকেছে ।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হলো। ইংরেজরা এইরূপ ভাগাভাগি করে ভারত ছেড়ে চলে যায়। পাকিস্তান আবার দুই ভাগে ভাগ হয়- পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলা, পর পূর্ব পাকিস্তান। এবার পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে শুরু হলো রাজনীতি। বাংলা ভাষা সংখ্যা গরিষ্ঠের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে অস্বীকৃতি জানায় উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্র এবং আন্দোলনকারীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবী কঠোর হস্তে দমন করা হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। বাংলা ভাষার জন্য ছাত্র জনতা জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে নাই। তবে সে আরেক রাজনৈতিক ইতিহাস । রাজনীতি ধীরে ধীরে অন্য খাতে প্রবাহিত হয়ে চরম সংঘর্ষে পরিণত হয়। ভাষা আন্দোলন চলতেই থাকে ।
এই ভাষা আন্দোলন থেকেই রাজনীতি অর্থনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা ও বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে জনগণ ধীরে ধীরে সোচ্চার হয়ে উঠে। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বেশি ভোট ও আসন পাওয়ার পরেও বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না করায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা লাভ কেের।
স্বাধীন দেশের নাম হয় বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং সকল রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) ২১ ফেব্রুয়ারি দিবসটাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সারা দুনিয়ায় প্রতি বছর মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
কাজী হাবিবুর রহমান: ট্রাস্টি ও উপদেষ্টা, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্ট ।
0 Comments: