[লেখাটি ১৪ এপ্রিল ২০২৩ খিস্টাব্দে সম্প্রীতির প্রথম র্বষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল।]

বৈশাখ আজ আমার কাছে আলো
শুচি সৈয়দ
পৃথিবীর প্রায় ত্রিশ কোটি বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ আজ সর্বজনীন উৎসবের দিন। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মানুসন্ধানের দিন। শুভ হালখাতার দিন- সারা বছরের অর্থনৈতিক লেন-দেন, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, শুভ-অশুভের জের-ইজা, ভালো ও মন্দের হিসাব-নিকাশের দিন। সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যাণ কামনার দিন। সত্য-সুন্দর-শুভকে আবাহনের দিন। বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান এবং বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠি— এ দিনে সবাই বাঙালি, শুধুই বাঙালি— "বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ' এই চেতনার দিন। বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসবের সূচনা ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে।
অকুতোভয় একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সাহসী উদ্যোগ থেকে সূচনা ঘটে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসবের। সাহসী এই সাংস্কৃতিক কর্মী ও অনুরাগীরা সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু, ভয়-ভীতি, দমন-নিপীড়ন সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে ১৩৬৭ বাংলা, ইংরেজি ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেন। এ জন্য তাদেরকে জেল-জুলুম পোহাতে হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত— রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সাফল্যের সঙ্গে পালনও করেছেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর টলিয়ে দিয়েই তাঁরা কেবল থেমে যাননি- তারা গোটা সমাজের সার্বিক অচলায়তনটিকে ভেঙে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছেন। আর সেই তাগিদ থেকে নিজেরা সংগঠিত হয়েছেন। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু জাতীয়তাবোধকে পুনর্জীবিত করে রাজনৈতিক লড়াইকে মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁদের সেই সংগঠিত সংগঠনের নাম ছায়ানট। ছায়ানট ধ্রুপদী রাগ সংগীতের একটি রাগের নাম। কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার বইয়েরও নাম।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চিন্তা করলেন এই সাফল্যকে ধরে রাখতে হবে এবং সেটা একটা সাংগঠনিক তথা প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বে। জয়দেবপুরে এক পিকনিকে গিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন- ছায়ানট এই নামে একটি সংগঠন গঠনের; সেই শুরু। ছায়ানট-এর নামকরণ করেছিলেন ফরিদা হাসান। কবি সুফিয়া কামালকে সভাপতি এবং ফরিদা হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত ছায়ানটের প্রথম কমিটি। ওই পিকনিকের উদ্যোক্তা ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক মোখলেসুর রহমান [সিধু ভাই], উপস্থিত ছিলেন শামসুন্নাহার রোজ, সাংবাদিক আহমেদুর রহমান, মীজানুর রহমান ছানা, ওয়াহিদুল হক, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সানজীদা খাতুনসহ আরো অনেকে।
বাংলা ভাষার কবি, বাঙালি জাতির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জংলি শাসকের হাত থেকে বাঁচাতে সেদিনের সেই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত সূচনা ঘটাল একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের। ছায়ানটে শিল্পীরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে। ছায়ানটের সূচনালগ্নে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রেরণা থাকলেও ছায়ানট বাঙালি জাতির সমগ্র সংস্কৃতি চর্চার প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে। ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান ছিলো পুরনো বাংলা গানের আসর। বিভিন্ন সময়ে ছায়ানটের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিক কামাল লোহানী, জিয়াউদ্দীন, জাহিদুর রহিম, সাইফউদদৌলা, ইফফাত আরা দেওয়ান, খায়রুল আনাম প্রমুখ।
বাংলা সংগীতের ঐতিহ্য তুলে ধরতে এবং সংগীত রুচি গঠন ও প্রসারের লক্ষ্যে ছায়ানট আয়োজন করে শ্রোতার আসরের। শ্রোতার আসরে বিভিন্ন সময়ের আয়োজনে থাকে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, পুরনো দিনের বাংলা গান, লালন শাহের বাউল গান, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গণসংগীত প্রভৃতি। শ্রোতার আসর করতে গিয়েই ছায়ানটের সংগঠকরা উপলব্ধি করতে পারেন দেশে শিল্পীরও স্বল্পতা রয়েছে। এই উপলব্ধির একটাই উত্তর নতুন শিল্পী তৈরি করতে হবে। আর সেই উপলব্ধি থেকেই তাঁরা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ‘ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। এই সংগীত বিদ্যায়তন থেকে সংগীতে শিক্ষা নিয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার শিল্পী ।
ছায়ানট কেবল ললিতকলার চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ছায়ানট দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ-দুঃসময়ে দেশবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত জনপদে, বন্যাপীড়িত গ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধে একেবারে বলা যায় রণাঙ্গণে
ছায়ানটের শিল্পীরা ছিলো জীবনের লড়াইয়ে, মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে। বাঙালি জাতির নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের সংশপ্তক ছায়ানট। ছায়ানটের সে লড়াই অব্যাহত আজও । বিভিন্ন সময়ে ছায়ানটের উদ্যোগে গুণীজন সংবর্ধনা যাঁদেরকে দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন, অমলাশঙ্কর, অর্ঘ্য সেন, আঙ্গুরবালা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্পনা যোশী, কৃষ্ণা চট্টোপ্যাধায়, গোপাল হালদার, গোরা সর্বাধিকারী, দীপালি নাগ, ড. দুলাল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, নীলিমা সেন, মায়া সেন, শর্বাণী হোম, শুভ্রা গুহ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুশীল মল্লিক, মৈত্রেয়ী দাস প্রমুখ।
ছায়ানটের আমন্ত্রণে যাঁরা এসেছেন এবং ভূমিকা রেখেছেন ছায়ানটের অনুষ্ঠানে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি শঙ্খ ঘোষ, কবি শামসুর রাহমান, শ্রীমতি মীরা মুখোপাধ্যায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যয়, শ্রী বাচেলাল মিশ্র, শ্রীচন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ছায়ানটের শ্রোতার আসর এবং ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছেন ওস্তাদ বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার, আভা আলম, নারায়ণ চন্দ্র বসাক, আজাদ রহমান, ওস্তাদ ফুল মহম্মদ, মধুছন্দা দাস, বেলা ইসলাম প্রমুখ। ছায়ানটে চর্চা হয় নৃত্য, নাটক এবং আবৃত্তির। সংস্কৃতির সব শাখাকেই ছায়ানট সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে এই সংগঠনকে।
নানা প্রকার অপপ্রচার অপবাদ ছড়িয়ে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই মহৎ উদ্যোগের। দেখানো হয়েছে ভয়। তোলা হয়েছে নানান প্রতিবন্ধকতা কিন্তু সবকিছু অগ্রাহ্য করেই দৃঢ় চিত্তে অম্লান সাহসে এগিয়ে গেছে ছায়ানট। ছায়ানটের যাত্রাকে বিঘ্নিত করতে নববর্ষের পুণ্য প্রভাতে আসা মহিলা দর্শকদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ফোটানো হয়েছে বোমার বিস্ফোরণ- রমনার অশ্বত্থমূলের মঞ্চে, তবুও ছায়ানট সমস্ত অশুভের বিশুদ্ধে, অকল্যাণের বিরুদ্ধে তার সংস্কৃতির সংগ্রাম জারি রেখেছে, জারি রাখবে।
0 Comments: