
আবদুল হামিদের কথা
আমিরুল ইসলাম রাঙা
পাবনা শহরের প্রধান সড়কের নাম 'আবদুল হামিদ সড়ক’। আবদুল হামিদের পুরো নাম আবুল মাকসুদ আবদুল হামিদ কোরাইশী। তাঁর বসবাস ছিল পাবনার শালগাড়িয়ায়। জন্ম ১৮৮৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন প্রাক্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য, পাবনা জেলা বোর্ড ও পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান। পিতা আবুল মাকসুদ কোরাইশী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের শিক্ষানুরাগী ও ডিভিশনাল স্কুল ইন্সপেক্টর। বাবার সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন স্থানে থাকতেন। অবিভক্ত ভারতবর্ষের হুগলী জিলা স্কুল থেকে ১৯০৪-এ প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পাশ করেন। ১৯০৬ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আইন শাস্ত্রে পড়াশুনা করেন। পরে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় তাঁর স্ত্রী ফাতেমা চৌধুরী (জমিদার মজিদ চৌধুরীর একমাত্র কন্যা) মৃত্যুবরণ করলে তিনি চাকরি ছেড়ে পাবনা চলে আসেন। পরে টাঙ্গাইলের পাকুল্লার জমিদার আবদুল হক খান চৌধুরীর কন্যা আসিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন।
শিক্ষা জীবনে আবদুল হামিদের সহপাঠী ছিলেন ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ড. শহীদুল্লাহর স্মৃতিকথায় বলা হয়েছে, আবদুল হামিদ খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পড়াশুনায় তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। কখনো ড. শহীদুল্লাহ প্রথম হতেন, আবার কখনো আবদুল হামিদ প্রথম হতেন।
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে আবদুল হামিদ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হলে প্রথম বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে সদস্য (এম এল এ) নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তাঁকে ‘খাঁন বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরীক হলে তিনি ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রত্যাখান করেন। তিনি বৃহত্তর পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন।
১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসেবে পুনরায় এম এল এ নির্বাচিত হন। এখানে স্মরণযোগ্য যে, ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হলে তিনি পাবনা অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে সফল হন। আবদুল হামিদ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ সদস্য (এম সি এ) নির্বাচিত হন। তিনি পাবনা জেলা বোর্ডের সদস্য এবং আমৃত্য পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।
আবদুল হামিদ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে যে কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা অবস্থান নেন তাঁদের মধ্যে আবদুল হামিদ ছিলেন অন্যতম। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পাবনায় ভাষা আন্দোলনে বিশাল অবদান রাখেন। ১৯৫২ সালের ৫ মার্চ পাবনা টাউন হল মাঠে তাঁর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ৫ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশনে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই বক্তব্য প্রদান করার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাঁকে করাচীর জিন্নাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য প্রদান করায় তৎকালীন সরকার তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়। এর ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সরকারের প্রছন্ন ইঙ্গিতে ডাক্তার এবং নার্সরা তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করে। এরই এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ৮ এপ্রিল ভোররাতে করাচী জিন্নাহ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তাঁর পরিবারের অনুমতি না নিয়েই ঐদিন বিকালে করাচীর গোরা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করে। করাচির একজন অবাঙালি সমারসেট হাউজের (এমসিএ-দের হোস্টেল) ম্যানেজার আবদুল গনি মরহুম আবদুল হামিদ কোরায়শীর কবর বাঁধানোর পর তার ওপর বাংলায় ‘শহীদ’ শব্দ লিপিবদ্ধ করেন।
আবদুল হামিদ মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী এবং সাত ছেলে এক মেয়ে রেখেযান। তাঁর সন্তানেরা হলেন আবুল মনসুর কোরাইশী, আবুল নাছার কোরাইশী, আবুল ফজল কোরাইশী, আবুল আতা কোরাইশী, হামেদ মাহমুদ কোরাইশী, ব্রিগেডিয়ার অব. নসরত আলী কোরাইশী, আনসার আলী কোরাইশী এবং লতিফা বেগম।
আবদুল হামিদের পঞ্চম পুত্র হামেদ মাহমুদ কোরাইশী পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সালে দুই মেয়াদে জিএস ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। আবদুল হামিদের এক পুত্রবধু হাসিনা কোরাইশী আশির দশকে পাবনায় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে আবদুল হামিদের একমাত্র পুত্র আনসার আলী কোরাইশী জীবিত আছেন। তিনি চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করেন।
পাবনাবাসীর দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পাবনা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহরের প্রধান সড়কের নাম দেয় আবদুল হামিদ সড়ক। ২০০৮ সালের মে মাসে পাবনা পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান মিণ্টু পাবনার এই কৃতী পুরুষের পরিচিতি ফলকের ভিত্তি স্থাপন করেন।
শেষ কথা : সরকারের কাছে আবেদন অনতিবিলম্বে আবদুল হামিদকে ভাষা সংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। তাঁর কবরটি পাকিস্তানের করাচি গোরা কবরস্থান থেকে বাংলাদেশে এনে পাবনায় করা হোক। তাঁকে উপযুক্ত সন্মান প্রদান করে একুশে পদক প্রদান করা হোক।
আমিরুল ইসলাম রাঙা : বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও ইতিহাস গবেষক
0 Comments: