
[লেখাটি ১৪ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এ প্রকাশ হয়]
ভূমি পুত্র আমানুল হক
মানুষের জীবন-সংগ্রাম ছিল যার মূল উপজীব্য
আমাদের সাত ভাই আর দুবোনকে নিয়ে ছিল আমার মা-বাবার পরিবার। আমানুল হক ছিলেন দ্বিতীয় অর্থাৎ আমাদের মেজভাই। তাঁর ডাক নাম ছিল মতি; তাই আমাদের কাছে আমানুল হক ছিলেন মতিভাই। পরিবারের মেজ সন্তান চলে গেছেন চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে মতি ভাইয়ের বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। থাকতেন বড় ভাই আজমল হকের কাছে। সব ভাই বোনের মধ্যে এ ভাই ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির, সম্পূর্ণ অন্য এক চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন আমার সেজ ভাই আসাদুল হকের মাত্র দেড় বছরের বড়। আসাদুল হক জন্মালে এ ভাইটি মা-কে আদর করতে দিতেন না, এমনকি মায়ের পাশে শোয়াতেও তার ছিল দারুণ আপত্তি। মা-কে তিনি কোনক্রমেই ছাড়তে চাইতেন না। মাও যতদিন বেঁচে ছিলেন এই মেজ ছেলেকেই সবচেয়ে ভালবাসতেন; কারণ আমার এ ভাই চিরকুমার ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর আগে প্রধান চিন্তা ছিল তাঁর অবর্তমানে এ ছেলেকেকে দেখবে? তাই মায়ের সীমাহীন চিন্তা ছিল তাঁর মেজ ছেলে মতিকে নিয়ে। অসুখে ভোগার কারণে তাঁর মেজাজ অন্যদের মত ছিল না। অন্যের ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল তাঁর পছন্দের বাইরে। তিনি অন্যের ব্যবহার্য বস্তু স্পর্শও করতেন না। অন্যের বিছানা, চেয়ারে বসা, অন্যের থালা, গ্লাস, কাপে খাওয়াতে তাঁর ছিল ভীষণ আপত্তি। বহুবার হাত ধুতেন; দিনে একাধিকবার গোছল করতেন। তিনি শুধমাত্রু ভাতই খেতেন। তাঁর আহার ছিল খুবই কম পরিমাণ; এক চামচ। কখনও তার চাইতেও কম। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি তাঁর ক্ষীণ স্বাস্থ্য এবং সব সময় বলতেন, পেটে ব্যথা। তাঁর ছিল পেপটিক আলসার। ছিল ভীষণ রকমের ডাস্ট এলার্জি, ধুলার কারণে হাজারবার হাঁচি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তিনি সব সময় মোজা ও ধূসর রঙের পাঞ্জাবী এবং বাদামী, কাল ও নীলচে ধরনের ফুলপ্যান্ট পরতেন।
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল; ছবি আঁকায় তিনি ছিলেন পৈত্রিক গুণের অধিকারী। স্কুলে পড়াশোনার সময়ই মতি ভাই ফটোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। স্বল্প মূল্যের বেবী ব্রাউনী ক্যামেরা ব্যবহার করে অপূর্ব চিত্রমালা ধারণ করতে থাকেন। খবরের কাগজ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে কলকাতা থেকে ভিপি যোগে ক্যামেরাটি কিনেছিলেন। কলকাতায় পত্রালাপের মাধ্যমে ডাকযোগে ছবি তোলার জন্য ফিল্ম আনাতেন মতিভাই। প্রথম দিকে একবার আমার মা তাঁর ডাকযোগে আনা ফিল্ম খুলে ফেলায় সে ফিল্ম দিয়ে আর ছবি তোলা সম্ভব হয়নি।
ইতিহাস সমৃদ্ধ শাহজাদপুরে আমাদের বাড়ি। শাহজাদপুর ও এর আশেপাশে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, বড়পাঙ্গাশী, কড্ডা, রূপজুর, পোতাজিয়া, রাউতারা ইত্যাদি প্রত্যন্ত সব গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতেন সেই শৈশব থেকেই। আমার বাবা ডাক্তার আবদুল হকের ডায়রিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আমানুল হকের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯২৫ (২৬ কার্তিক, ১৩৩২ বাংলা সন) শনিবার সন্ধ্যাবেলা। ১৯৪৩ সনে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। স্কুল জীবনে শুরু করা ফটোগ্রাফী চর্চায় খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হয়। তখন থেকেই ছবি তোলার জন্য সকালবেলায় উঠে কত দূরে দূরে চলে যেতেন; সারাদিন খাওয়া হত না। অতি অনিয়মই তার জীবনে স্থায়ী আলসারের জন্ম দেয়, ফলে স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়। এত ক্ষীণ দেহের একজন ব্যক্তি যে ভারী ভারী একাধিক ক্যামেরা ও বিভিন্ন ধরনের লেন্স নিয়ে কিভাবে ছবি তুলতে যেতেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কোথা থেকে পেতেন সারা দিন পিঠে কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে, গলায় ক্যামেরা ও লেন্স ঝুলিয়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে ছবি তোলার শক্তি। মৃত্যুর আগে দেখা গেছে বহু খোঁজ করে ক্যামেরার ফিল্ম সংগ্রহ করে ছবি তুলছেন।
১৯৫০ সনের পূর্বেই কলকাতার নতুন সাহিত্য এবং আরো একাধিক পত্রিকায় তাঁর তোলা ছবি ছাপা হয়। ১৯৫১ সনে ইংল্যান্ডের Festival of Britain-এ তাঁর আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয় এবং তারপর বহু দেশি-বিদেশি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্র স্থান পায়। এ দেশের দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও তাদের জীবন-সংগ্রামকে তাঁর চিত্রকর্মের মূল উপজীব্য বিষয় করে তোলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সান্নিধ্যে তিনি আসতে পেরেছিলেন তাঁর শিল্পী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে; তাঁরই আগ্রহে ঢাকা আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখেন। Artist Cum
Photographer হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ভাষা শহীদ রফিকের কপালে গুলি লেগে মাথার খুলিসহ সম্পূর্ণ মগজ ছড়িয়ে পড়ে থাকা চিত্রটি আমানুল হকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুলেছিলেন।
মতি ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল সিনেমাটোগ্রাফী শিখে নিজের দেশকে মনের মত করে সিনেমায় তুলে ধরবেন। জীবনের বাস্তবতায় তিনি উপলব্ধি করেন এ পথে অনেক সমস্যা। তাঁর জীবনের সবটুকু স্থান করে নেয় আলোকচিত্র Photography-
অন্তর-আত্ম সব অনুভূতি জুড়ে ছিল একটি শব্দ ‘ছবি। সহজাত শিল্পীসত্তা তাঁকে টেনে আনে শিল্পকলার এ শাখাটিতে। অনেক বড় অসীম দিগন্তে জীবন সমৃদ্ধ শিল্প সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন আ নিবেদিত। ক্যামেরা, মূল্যবান লেন্স, অজস্র ফিল্ম, এরপর বাধাই করে প্রদর্শনী করা- এসবে তাকে হিমশিম খেতে হত। তবে সাধারণ সীমাবদ্ধ আয়ে চলা পরিবারের সবাই তাকে সাধ্য মত আন্তরিকতার সঙ্গে এসব যোগান দিতে সচেষ্ট ছিল।
তিনি কলকাতা চলে যান সিনেমার কাজ শেখার আশায়। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের স্নেহভাজন বন্ধু। যখন আমানুল হক বাংলাদেশের জীবন প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে বিশাল ফটোগ্রাফিক গ্রন্থ রচনায় ব্যাপৃত তখন সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্যে আমানুলের প্রতিভার স্বীকৃতি মেলে—
"For over a generation he (Amanul
Haque) has virtually recorded every aspect of life in his country, recaling a
deep love for Bangali life and culture in all its manifestations..."
সম্প্রতি আমানুল হকের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম 'ক্যামেরা স্বদেশের মুখ, ছবি ও কথা : আমানুল হক।’
সত্যজিৎ রায়ের আশিতম জন্মদিনে আমানুল হকের তোলা আলোকচিত্র শোভিত একটি অ্যালবাম সিঙ্গাপুর মুদ্রিত, প্রকাশিত হয় সত্যজিৎ সোসাইটি দিল্লির উদ্যোগে। বাংলাপিডিয়াতে আমানুল হকের অসংখ্য চিত্র স্থান করে নিয়েছে। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে রয়েছে আমানুল হকের বাংলায় 'একুশের তমসুক’ ও ইংরেজিতে বাংলা স্যুভেনীর দুটি বই। তাঁর আলোকচিত্র সম্বলিত সত্যজিৎ রায়ের উপরে লেখা 'প্রসঙ্গ সত্যজিৎ’ আমানুল হকের আরেকটি শ্রমলব্ধ ফসল। তার চিত্রে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ সংকলন স্মৃতিচিত্র আরেকটি বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে 'ভাষা সৈনিক’ ও ২০১১ সনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা 'একুশে পদক’ লাভ করেন এই বরেণ্য আলোকচিত্র। তিনি বাংলা একাডেমির সম্মনসূচক ফেলোশিপ লাভ করেন ২০০৯ সনে। এছাড়া জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা ও The Daily Star-এর পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা ও স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করা হয় তাঁকে।
এ দেশের মেলা-পার্বণ, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি ও শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কি যে উৎসাহ ছিল তা তুলে ধরতে বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন। ছোটবেলায় শাহজাদপুরে আমাদের ছোট দুবোনকে গ্রামের মেলায় নিয়ে যেতেন; কিনে দিতেন মাটির পুতুল, ঘোড়া, টিয়াপাখি, ইলিশ মাছ, পাখি, রঙিন পাখা, কাগজের ফুল। আমরা মজা করে খেতাম গজা, মটকা, মুড়কি, খৈ, চিনির ঘোড়া, রথ, হাওয়াই মিঠাই ইত্যাদি।
আমার সন্তান ছোট্ট অনুপমের অবুঝ মনের কল্পনায় ছোট হাতের আঁকা ছবি সোনারগাঁ লোক জাদুঘরের প্রদর্শনীতে জমা দিয়েছেন। আবার আমাদের সবাইকে সোনারগাঁ প্রদর্শনী দেখাতে নিয়ে গেছেন। অরূপের চার বছর বয়সে আঁকা ছবি তিনি যখন কলকাতায় যান তখন সত্যজিৎ রায়কে দেখান এবং সত্যজিৎ রায় দেখে উৎসাহব্যঞ্জক দুছত্র লিখে দিয়েছিলেন—
“এই দেখ কেমন এক সাহসী ইঁদুর,
বেড়াল পালাবে একে দেখে বহুদূর।”
অরূপের মেজ মামা আমানুল হকের এসব ললিতকলা চর্চায় উৎসাহ দানের শেষ ছিল না। আমানুল হক বেড়ে ওঠেন তৎকালীন পাবনা জেলার শাহজাদপুরে, এখানকার মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদী-নিঃসর্গের পরিমন্ডলে। নিঃসন্দেহে এখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি তার শিল্পী জীবন গড়ে ওঠার পশ্চাতে সীমাহীন ভূমিকা রেখেছে। যমুনা, করতোয়া, ফুলঝোর, হুড়াসাগর ইত্যাদি ছোটবড় নদী, বৃক্ষরাজির সমারোহ, অবারিত মাঠ, দিগন্ত বিস্তৃত শস্যের ক্ষেত, নদীতে নৌকা বাইচ, গুণটানা, সুর্যোদয়-সূর্যাস্ত, নদী-বিলে ফুটে থাকা অজস্র শাপলা ফুল, গ্রামের লাঠি খেলা, কবি গান, পুঁথিপাঠ আরো কত বৈচিত্রময় উপকরণ আমানুল হকের আলোকচিত্র ভান্ডারে স্থান করে নিয়েছে।
তিনি বার বার এসেছেন রাউতারা-পোতাজিয়ার রূপ-রস-গন্ধে ভরা প্রকৃতির কাছে মাটি ও মানুষের টানে, তার প্রিয় বোন এলি, বন্ধু অনাথ মাঝি আরো অনেক নাম না-জানা আত্মাীয় স্বজন ও গ্রামবাসীর কাছে। শাহজাদপুর গ্রামের বাড়িতে গেলে সহজে ফিরে আসতে চাইতেন না। ছবি তোলার প্রয়োজনে গ্রামের লোকের সঙ্গে তাঁর আত্মার আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে ছিল তরুণ যুবক, কৃষক, খেটে-খাওয়া দিন মজুর, নৌকার মাঝি। কেবল তাই নয় তাদের মা, স্ত্রী, বোনেরাও মতিভাইয়ের ভক্তে পরিণত হয়। এরা আমানুল হককে তাদের মত করে সম্বোধন করতো- মতিন ভাই বলে। আমানুল হকের প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠে রাউতারা গ্রামের অনাথ মাঝি। অনাথ মাঝির অসুখে চিকিৎসা করাতেন। চোখের ছানি অপারেশন করান। আমার মামাত ভাই মুনু, আমু, খালাত ভাই মামুন, শাহজাদপুরের পান্নু, কালু, জয়নাথ সবাই তাদের সব কাজ ফেলে রেখে সারা সময় মতি ভাই যত দিন গ্রামে থাকতেন তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে তাকে ঘিরে রাখত সর্বক্ষণ। মামাত বোন এলি ছিল তার ছবির মডেল শিল্পী। যেমন ভাবে তাকে ছবিতে দেখতে চাইতেন এলি শত কষ্ট হলেও সে দৃশ্যটি ফুটিয়ে তুলতে অশেষ চেষ্টা করেছে। আনন্দের সঙ্গে কোন কষ্টকেই কষ্ট মনে করেনি। নদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কি বৃষ্টিতে লাগাতার ভিজে থাকা কিম্বা প্রখর রোদে ধান শুকানো সবই যেন সৃষ্টি সুখের আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠতো তাঁর ক্যামেরায়।
0 Comments: