
পাবনাবাসীর ভোজনে বিবর্তন
মোসতাফা সতেজ
জীবন যতই গতিময় হয়ে উঠছে, ততই তৈরিকৃত কেনা খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বদলে গেছে সকাল-দুপুর আর রাতের খাবার পদ। এই বদলটা শুরু হয় আশি ও নব্বই দশক থেকে। খাদ্যের চাহিদা যত বাড়তে লাগল ততই মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতাও বাড়তে থাকল। তলানে আসবে খাদ্য অভ্যাস বদলানোর হেতু সন্ধানে পাওয়া যায় রোজগার বৃদ্ধি এবং সচেতনতা। পত্র-পত্রিকায় মোবাইল পাওয়া রেসিপি এবং চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত রন্ধন প্রণালী থেকেই খাদ্যখানায় পদ যুক্ত হচ্ছে রকমারি। কিন্তু দেড়শ বছর আগে নি¤œবিত্ত পরিবারের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। এ জেলার অধিবাসীদের মধ্যে ৮৫ ভাগ ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি শ্রমিক ও জেলেরা ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। অর্থনৈতিক অবস্থা এতই শোচনীয় যে, শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্যেই সংগ্রাম এবং কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। ডব্লিউ-ডব্লিউ হান্টারের ১৮৭০ সালের বিবরণে বলা হয়, ‘কৃষক শ্রেণির মধ্যে সীমাহীন অজ্ঞতা এবং শিক্ষার অভাব।’
মানুষের জীবন অনিবার্যভাবেই খাদ্যকে অবলম্বন করে বিকশিত ও প্রবাহিত। তাই পান্তাপ্রিয় পাবনাবাসীর ভোজনে বিবর্তন ঘটে গেছে গত ৩৫ বছরে। সব পরিবারেই আমন ও আউশ ধানের চাল থাকে না। থাকে বিরি ধানের স্বাদহীন চাল। এরই ভিজে ভাত খেতে হচ্ছে অনেককেই। যাদের ঘরে ফ্রিজ আছে তারা খুব একটা পান্তা খান না। ফ্রিজে রাখা বাসি ভাত সকালে পেঁয়াজ মরিচ যোগে ভুনা করে খান। কেউবা ডিম ভাজি বা ঝুরি করে বাসি ভাত মাখিয়ে গরম গরম নাস্তা সারেন সকালে। পাস্তাার বিবর্তন ঘটছে এ ভাবেই। শীতকালে ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ যোগে করকরে ভাতে নাস্তা করারও প্রচলন আছে। দুপুরে গরম ভাতে পানি দিয়ে পান্তা করে খাওয়ানোর রেওয়াজ আগের মতো এখনো স্থান ভেদে চালু আছে। পান্তার পাশাপাশি বসন্তকালে ছিল রাঙা আলু বা মিস্টি আলু সিদ্ধ করে সকলের নাস্তা সারা। এ খাবারের চলও কমে যাচ্ছে। মেঘলা দিনে রোদ অভাবে সিদ্ধহীন ধান কড়াইতে ভেজে ঢেঁকিতে ভানা চালের ভাত গরম গরম খাওয়ানোর প্রচলন ছিল চরাঞ্চলে। এখন নেই। আজকাল শহরের বেশ কিছু শ্রমজীবীর পরেটা তরকারি যোগে হোটেলে নাস্তা সারেন। সাত সকালে যারা পান্তা ছাড়া অন্যান্য নাস্তা তৈরি করতে পারেন না সময়ের অভাবে, সে সব সংসারের পুরুষেরা ফাস্টফুডের দোকানে আশ্রয় নেন। পাবনা জেলা গেজেটিয়ার (১৯৯০) লেখে, কৃষকেরা সাধারণত, পান্তাভাত খেয়ে দিনের কাজ শুরু করে। পান্তা হলো পানিতে ভিজিয়ে রাখা রাতের উদ্বৃত্ত ভাত। মাঠের কাজে যাওয়ার আগে তারা কাঁচা মরিচ, পেয়াঁজ ও লবণ দিয়ে এই ভাত খেয়ে নেয়। কিছু পরিবার চালের তৈরি মুড়ি ও চিড়া নাশতা হিসেবে ব্যবহার করে। .......বিত্তবান মুসলমানেরা মাঝে মাঝে ঘিয়ে তৈরি পোলাও, কোর্মা প্রভৃতি সুস্বাদু খাবার খেয়ে থাকে। কোন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে ও অতিথি আপ্যায়নের জন্যই এ ধরণের উৎকৃষ্ট খাবারের আয়োজন করে। মুরগী, খাসি ও গরুর মাংস এবং মাছ দিয়ে নানা প্রকার খাবার তৈরি করে। খাওয়া শেষে খাঁটি দুধের তৈরি দই পরিবেশন করা হয়। থাকে অন্যান্য মিষ্টান্ন। বেড়া ও শাহজাদপুরের দই পাবনা জেলার গৌরবের বস্তু।
জমিদারের কর্মচারী ও অন্যান্যদের দয়া ও করুণার ওপর একান্ত নির্ভরশীল ছিল কৃষি শ্রমিক। তারা জমিদারদের স্বার্থে নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনে আগ্রহী ছিল না। গায়ের লোকেরা বাঁশের মাচানে এবং মাদুর বিছিয়ে ঘুমায়, লুঙ্গি ছাড়া আর কোন কাপড় পরে না। তারা পান্তা ছাড়া কী খাবে?
ভোক্তা এখন ভোগবাদী সভ্যতার। সেকালে পাবনা ছিল নিম্নবিত্তের। এখন উচ্চবিত্তের সংখ্যা আর হাতে গোনা যায় না বলে ভোজনবিলাসীর দল ভারী হচ্ছে। শহরের ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট জীবনে ক্লাস সেন্টিমেন্ট বা নাক উঁচু করা মানসিকতার মাত্রা যত বাড়ছে, জীবন যত গতিময় হচ্ছে, ভোক্তারা স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে ততই সংকুচিত হয়ে পড়ছে পান্তা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নাস্তায় পরিবর্তন আসতে থাকে।
অনেক পরিবারেই গ্রীস্মকালে সকালে পান্তার স্থান দখল করে নিয়েছে বেকারী এন্ড পেস্ট্রি খাদ্য, পুডিং, খিচুড়ি চা বিস্কুট, পাউরুটি, ডিম টোস্ট কলা, পরোটা, হালুয়া-রুটি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (এশীয় ও পশ্চিম দেশীয়) খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ির ওভানে জায়গা করে নিচ্ছে। বাঙালি জীবনও দ্রুত গতিতে চলার ফলে এখন আর কারোরই তেমন অবসর নেই। শিশুদের নাস্তায় বিপ্লব ঘটিয়েছে চাউমিন, নুডলস। যা সিদ্ধ করতে সময় কম লাগে বলে রাধুনীদের কাছেও সমাদৃত। ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবীরা অবশ্য সকালে গরম ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বানানো খাবার টিফিন কেরিয়ারে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু ভোক্তা নাস্তা সারেন পরোটা-সবজিতে।
খাদ্য রুচি এবং রস আস্বাদন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ জনগোষ্ঠীর একেবারে নিজস্ব। অবশ্য রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয় পরিবারের ভোগবিলাস। একুশ শতকে এসে নাস্তার রকম রকম পদ যুক্ত হতে থাকে। অগোচরে খাদ্য খানায় ঘটে যায় বিপ্লব।
সাত সকালে খেয়েই রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া। গত শতকের নব্বই দশকের মাঝমাঝি সময়ে ঢাকায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনে পান্তা ভাতে যুক্ত করা হয় ইলিশ। থালার বদলে শানকি। দু’দশক যেতে না যেতেই এ ব্যবস্থা ফিকে হতে থাকে মাছের দাম বাড়ার কারণে। চিরাচরিত পান্তা ভাত খাওয়ার অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। ঋতু ভেদে সেই আমন-আউসের লালচে চালও পাওয়া যায় না, বাজার কাটতি চালেও স্বাদ নেই।
জেলাবাসীর পুরাতন ভোজ্য তালিকা পাওয়া যায় না। সেকালে খাদ্য দিগন্তের সীমানা ছিল এখন নেই। দিগন্ত বিস্তৃত এটাই খাদ্য বিপ্লব। যুগে যুগে খাদ্য-বস্ত্রের বিবর্তন হয়। সেকালের মনীষীরা ভোজন পর্বকে মহৎ কাজ বলে মনে করতেন না। তাই খাদ্য খানার কথা তাদের লেখায় স্থান পায় নি। দু’চারজনের লেখায় টুকটাক পেলেও বিস্তারিত করা হয়নি পদের নাম।
এ জেলার রন্ধন শিল্প ঐতিহ্য মন্ডিত না হলেও পরিশীলনে গতানুগতিক। ভোজের বিশিষ্টতা রকমারি মাছের বদৌলতে। নানা রকম পদ সৃজন করেছেন রাঁধুনীরা। হেঁশেল হয়েছে যন্ত্র নির্ভর রান্নাঘর, কিচেন রুম। কাঠ-খড়ির বদলে গ্যাস। ব্যঞ্জনের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বদলে গেছে তৈজসপত্রও। মাটি আর কাঁসা পেতলের তৈজসপত্র ব্যবহার নেই বললে চলে। গত শতকের নব্বই দশক থেকে চালু হয় প্লাস্টিক। মেঝেয় পাটি বিছিয়ে, পিড়ি বা আসনে বসে খাওয়ার অভ্যাসও বদলে যাচ্ছে। অনেক পরিবারেই খাদ্য-খানা চলে টেবিল চেয়ারে।
সান্ধ্যকালীন ফুটপাথের ভ্রাম্যমান রেস্টুরেন্ট ব্যবসাও বাড়ছে। চটজলদি খাবারে ভোক্তাদের আগ্রহও বাড়ছে। কাঁচ ঘেরা রিকশা ভ্যানে বিকোচ্ছে ফুচকা, চটপটি, চিকেন রোল, সবজী রোল, বট (ভুড়ি ভাজা), চিকেন ফ্রাইসহ প্রায় পনের পদের খাবার। মাসালা মুড়ি, আলু ও পিঁয়াজি বড়া তো আছেই। স্বাস্থ্য হানির ভয়ে সচেতন মানুষ এদিকটায় খুব বেশি ঘেঁষেন না। কোন্ খাবার খেলে কতখানি পুষ্টি পাওয়া যাবে, কোন্ খাবার কতখানি হাই জিনিক না আন হাইজিনিক- সে ভাবনা শিকেয় তুলে পেটের আগুন নেভানোকে গুরুত্ব দিয়ে এসব খাবার খেয়ে যাচ্ছেন।
ত্রিশ বছর আগেও চায়ের দোকানে মালাই (দুধের স্বর) রুটি পাওয়া যেত। এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দুধ চা দুলর্ভ হয়ে পড়ছে। মালাই জুটবে কোথা থেকে! দু’চারটি দোকানে পাউডার বা কৌটার ঘন দুধের চা কিছু খাদকের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যের কথা লিখতে গেলে ধান ও গমের কথাও এসে যায়। যাকে বলে ধান ভাবতে শিবের গীত।
ধনধান্যে পুষ্পে ভরা কথাটা শুধু গানে নয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে জড়িয়ে আছে। গত শতাব্দীতেও এ দেশের প্রধান ফসল ছিল ধান। যা প্রায় পরিচর্যা ছাড়াই ফলতো। আবাদযোগ্য জমিতে পোকা মাকড়ের তেমন উপদ্রব ছিল না। কেবল মাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল। বীজ ছড়ালেই ধান গাছ হতো। আপন নিয়মে ধানের ছড়া দোল খেত বাতাসে। ধানসিঁড়ি তো কাব্য পাঠকের পরিচিত। নবান্নে নাকে এসে লাগত নতুন ধানের মিঠে ঘ্রাণ। নবান্ন উৎসব এবং পৌষ পার্বণ এখন বইয়ের পাতায় আটকে আছে। ভোক্তারা রেডিমেট সলতের জীবন উপভোগ করছে। দোকানের তৈরি খাবারই তাদের টানছে। খাদ্য অভ্যাস বদলানোর হেতু সন্ধানে পাওয়া যায় রোজগার বৃদ্ধি। পকেট গরম থাকলেই জেগে ওঠে শখ। সেই জায়গা থেকেই সেজে উঠছে রান্নাঘর।
১৯২৫ সালে প্রকাশিত পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, জেলার সবত্র সিগারেট বিড়ি চলে। মদ-গাঁজা-আফিম বেচা কেনা থেকে বছরে গড়ে দুই লক্ষাধিক টাকা সরকারের আয় হয়। সকালের নাস্তা সম্পর্কে লেখা হয়, লবণ ও মরিচ সংযোগে ভেজানো ভাত গরিবের কাছে তৃপ্তিকর প্রাত:রাশ। অন্যরা, মুড়ি, চিড়া, খই, রুটি, কলা, দই, দুধ, ভাজি তরকারি, হালুয়া পরোটা খেয়ে থাকে। ফলের কালে আম-কাঁঠাল।
মিষ্টির কথায় সংক্ষেপে লেখা হয়েছে, চাটমোহরের রসকদম, রাঘবসই, বাগবাটির সন্দেশ, মোন্ডা, পাবনার রসগোল্লা, চমচম, কাঁচা গোল্লা, ছানাবড়া, বোদে ও সাদিয়া চাঁদপুরের পানিতোয়া। এছাড়া সুজানগরের নিশ্চিন্তপুরের একসের ওজনের বাতাসা।
তিনি আরও লেখা হয়, ‘মহার্ঘ। সকলের পক্ষে উপযোগী নহে। রুটি লুচি এ দেশের লোক কম ব্যবহার করে। বিয়ের অনুষ্ঠানে লুচি মিস্টি ব্যবহার করা হয়। খিচুরি-পোলাউ স্থান ভেদে খাওয়ার রীতি আছে। মাংসের মধ্যে পাঁঠা-খাসি-মুরগি ব্যবহার বেশি। গরুর মাংস ব্যবহার কথা লেখা হয়নি।
রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা রাঁধুনী ১৪১৪ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ১ মার্চ স্কয়ার কিন্ডার গার্টেন স্কুল চত্বরে। বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো জাতীয়ভাবে ফিরিয়ে আনতে সৃজনশীলতা বিকাশের লক্ষে স্কয়ার কনজুমার এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে রেসিপি নিয়ে অংশ নেন রাঁধুনীরা। তাদের মধ্যে দুইজন পুরুষও ছিলেন। বেশির ভাগ রেসিপি ছিল ইলিশ মাছের। দু’চারটি ছিল ব্যতিক্রম। যেমন কচু শাক, শুটকি, চাপলে আর লটকে মাছের রেসিপি। এর নাম ছিল সিদল।
এর আগে ২০০৫ সালের নভেম্বরে বন্ধন কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ও সৃজনশীল রান্না ১৭ অঞ্চল (পাবনা-সিরাজগঞ্জ)। শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ১৪১২ তে অংশ নেন ৫৫ জন। তারা দেখান সলে পাতায় লাউটাকি, নারকেলের দুধ দিয়ে ইলিশ মাছ। আস্ত ইলিশ, পাবদাসহ পাঁচ মিশালী ঝোল, টক দইয়ের মাছ, ইলিশ পোলাও, কচুর লতা ও চিংড়ি, দই ইলিশ, ইলিশ খিচুড়ি, রুই মাছের কোপ্তাকারী লাউ বোয়াল ঘণ্ট, ইলিশ চচ্চড়ি, ও চিংড়ি ঝিঙার দোপেয়াজা। মাংসের মধ্যে গরুর মাংসের পিটুলি, মাংসের ঘুগনি, ভুনা খিচুড়ি, ভুনা মাংস, মুরগির ঝাল মাংস। অন্যান্যর মধ্যে মুগডালের মুড়ি ঘণ্ট, লাউ ডাল, ডিমের মগজ, গোটা বেগুনের টক, করলা ডালকারী, মোগলাই পিঁয়াজু, কাঁঠাল বীচির তরকারি, ভাত ভাজি, পাকোড়া, সপ্ত ব্যঞ্জন, ডাল করলা চচ্চড়ি প্রভৃতি। প্রতিযোগিদের দেয়া রেসিপিতে ঐতিহ্যবাহী নোনা ইলিশ ছিল না। খাদ্য উপাদান প্রাকৃতিক। সমকালের রুচি অনুযায়ী ঐতিহ্য ফিরে আসে আলাদা আঙ্গিকে। ভোজনের প্রতি প্রায় সবারই বিশেষ অনুরাগ আছে। নিজস্ব রসনা মহিমায় আপ্লুত হয় খাদ্য চেতনা।
পাবনায় এই প্রথম রান্নার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। অনুভব জাগানো প্রতিযোগিতা। স্কয়ার কনজুমার প্রডাক্টসের রাঁধুনী আয়োজিত সৃজনশীল বিভাগে রসুন কিমা রান্নায় রেফাত ফাতেমা রিতা এবং ঐতিহ্য বিভাগে সলে পাতায় লাউটাকি রান্নায় তসলিমা ইসলাম পুরস্কৃত হন। তারা ১০ হাজার করে টাকা পুরস্কার পান। তাদের রেসিপি অনুভব করায় বিশেষ খাবারের প্রতি বিশেষ অনুপ্রেরণা কোন নিয়ম মেনে চলে না। রুচি এবং রস গ্রহণ এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব নিয়মে গড়ে উঠছে।
জেলার আনুমানিক ৪৫ শতাংশ মানুষ খাদ্য দরিদ্র। অতিগরিবের সংখ্যা বাড়ছে। এদের একাংশ বর্ষা ও শরৎ কালে জেলা শহর ও উপজেলা সদরের নয়ন জুলি এবং জলাভূমি থেকে শাপলা-শালুক ও কলমী শাক কুড়িয়ে খেয়ে থাকে। অন্যান্য ঋতুতেও মাঠে-ঘাটে সড়ক ও বাড়ির আশপাশে কুড়ানিরা এখনও শাক কুড়ায়। যা পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং সুস্বাদ। অপর দিকে উচ্চবিত্ত পরিবারে সকালের নাস্তায় যুক্ত হয়েছে জেলি, পাস্তুরাইজড মাখন, মোলায়েম ক্রিম। পাউরুটি যোগে খাওয়া। থাকে মিল্ক পাউডারের চা বা কফি। বিকেলে চা-পানে যুক্ত হয় পলিপ্যাকের পাস্তুরিত দুধ চা।
আগের মতো পান্তা ভাতে মদনা কলা চটকে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এ কলা এখন দুলর্ভ। রাতে লঘু ভোজনে অনেকে অভ্যস্ত। তাই তাদের কাছে আদর্শ খাওয়ার ছিল দুধ-ভাত। কেউ বাতাসা, গুড়, কেউ বা একটু চিনি ফেলে খেয়ে নেন। কেউ শুধু লবণ দিয়ে সাবাড় করেন। কিন্তু আজকাল খাঁটি দুধের অভাবে এ খাবারের চল কমে গেছে। গাছ পাকা সুঘ্রাণী সবরি কলা দুধে ভাতে মাখিয়ে খাওয়ার চল কমের দিকে । গ্রীষ্ম-বর্ষা কালে দুধ-আম-কাঁঠাল যোগে ভাত খাওয়ার চল আজকাল বাধাগ্রস্ত হয়েছে খাঁটি দুধ সংকটের কারণে। ১৯৯৩ সালের হামিদ রোডে অবস্থিত একটি ঘড়ির দোকানে রেফ্রিজারেটরে রাখা খাঁটি দুধ বিক্রি শুরু হয়। ১৪ টাকা লিটার। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সব মহল্লায় এ ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু খাঁটি দুধ এখন দুর্লভ। যাদের বাড়িতে দুধ-চা পানের অভ্যাস আছে তারা তরল ছেড়ে গুঁড়ো দুধ কিনে চা-এর তৃষ্ণা নিবারণ করেন। কিন্তু এ গুঁড়ো দুধও মান সম্পন্ন নয় বলে অনেকে লাল চা খান। কেউবা কনডেন্স মিল্ক ব্যবহার করেন। অথচ খাদ্য উপকরণে সমৃদ্ধ শহর ছিল পাবনা।
১৮৫৪ সালে ১২৬১ বঙ্গাব্দ সাংবাদিক ঈশ্বরদচন্দ্র গুপ্ত কলকাতা থেকে এ শহরে এসেছিলেন নদী পথে। ফিরে গিয়ে তিনি তার পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরে লেখেন, ‘পাবনায় অনেক প্রকার দ্রব্য পাওয়া যায়। মৎস, তরকারি, ঘৃত, দুগ্ধ, দধি, সুলভ বটে, কিন্তু পূর্বাপেক্ষা এ বৎসর দধি, দুগ্ধ ও ঘৃত কিঞ্চিৎ দুর্মূল্য হইয়াছে। ইহার কারণ মহামারী জন্য অনেক গোবৎস মারা পড়িয়াছে।’
৩০ বছর আগেও রসনায় স্বাদ পাওয়া যেত। এখন তা দুর্লভই বটে। গত আড়াই দশকে অনেকখানি বদলে গেছে শহরবাসী। তাদের খড়ের ছাউনি দেয়া হেঁসেল ঘর পরিণত হয়েছে কিচেনে। ঘুঁটে আর কাঠখড়ি জ্বালানি থেকে গ্যাসে উন্নীত। প্রযুক্তিবিদদের বদৌলতে কিচেনের অন্দরমহল এখন ঝকমক। তৈজস পত্রেও আধুনিকতার স্পর্শ। মেটে হাঁড়ি থেকে প্রেসার কুকার, ফ্রিজ। শানকি থেকে মেলামাইন। বাটা মশলা থেকে গুড়া মশলা। হামানদিস্তায় বা ঢেঁকিতে মশলা কোটার দিন আর নেই। এভাবেই বদলে গেছে খাবার দাবার। ভাত-রুটি ঠিকই আছে। পাশাপাশি ভোজন ভেলায় যুক্ত হয়েছে চাইনিজ খাবার। কোমল পানীয়। মেঝেতে আসন পেতে বড় কাঁসার থালায় ভাত ভর্তা পরিবেশনের দিন শেষ। পিড়ির বদলে এখন ডাইনিং টেবিল। বিয়ে বাড়ি, ভোজবাড়ি বা পিকনিকেও কলাপাতার বদলে রকমারি থালা। এ সবই স্মরণ করে দেয় পাল্টেছে সময়। বদলে গেছে জীবন যাপনের ধরণ। বদলে গেছে খাবার পদ। তাই মাতৃস্তন্যর বদলে এখন আধুনিক ফিডারে কৌটার দুধের চল ঘরে ঘরে। মুরগির মাংস হয়েছে ব্রয়লার। ডিমও তাই। ঢেঁকি ছাটা চালে পোল্লা ভর্তা, কাটারি শিম, মানকচু, মসুর ডাল বা ডিম ভর্তা খাওয়ার দিন আর নেই। কেবল টিকে আছে টাকি মাছ ভর্তা আর লাউটাকি। অসুস্থ লোকের পথ্য থেকে বার্লি ও সাগুর প্রচলন কমে আসছে। গ্লুকোজ খাওয়ারও একই অবস্থা। চালু আছে হরলিকসসহ বিলাতি খাদ্য। চিকিৎসকেরা ৪০ বছর আগে জ্বরে আক্রান্তদের ভাতের পরিবর্তে রুটি খাওয়ার কথাও বলতেন। পথ্য দিতেন চিকন চালের ভাত, কাঁচা কলা সিদ্ধ। ছোট মাছের পাতলা ঝোল। বর্তমানে এ সকল পথ্য বদলে গেছে। বাঁশের কোড় অত্যন্ত সুস্বাদু খাদ্য। খাদ্য উপকরণের মধ্যে বাঁশের শৈশব কালে কোড়-এর ওপর চাড়ি বা ঐ জাতীয় বাসন দিয়ে বাঁশ বনে ঢেকে রাখা হয়। কিছুদিন পর তা আলো-বাতাস না পেয়ে প্রায় বাধা কপি আকার ধারণ করে। এই কোড় ইলিশ মাছ দিয়ে ঘন্ট বা তরকারি করে খাওয়ার প্রচলন ছিল বাঁশেরবাদা ও আটঘরিয়ায়। এখন কমে এসেছে।
মাছে-ভাতে পাবনাবাসীর খাবার-দাবার প্রসঙ্গে প্রবীণেরা জানান, গত শতকের সত্তর দশকে কাউন চাষ হতো পাবনায়। এছাড়া বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারিপুর, বাখরগঞ্জ ও পাবনা এবং ভারতের ত্রিপুরায় ব্রিটিশ আমলে চিনা চাষ হতো। ধান চাষের এলাকায় দরিদ্র কৃষক বছরে কয়েক মাস চিনা খেয়ে জীবন ধারণ করেন। এটা দেখতে চালের মতো কিন্তু আকারে অনেক ছোটো। অনেকটা কাউনের মতো। চিনা পনের মিনিটেই সিদ্ধ হয়ে যায়। সাধারণত চালের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়। পৌষ মাসে রোপণ করা হয় এবং চোত মাসে পেকে যায়। বাজারে এটা পাওয়া গেলেও তা পাখির খাদ্য হিসেবে বিক্রি হয়। খাবার-দাবার নিয়ে সব কবি সাহিত্যিকই কম বেশি লিখেছেন। হাজার বছর আগের চর্যাপদেও খাবার কথা রয়েছে। আমরা এখন যাকে ‘চিনা’ বলি চর্যাপদে তাকে কঙ্গুচিনা বলা হয়েছে। রবি শস্যের মধ্যে কাউন ছিল প্রধান ফসল। বসন্তকালের শেষ দিকে কাউন পাকতে শুরু করে। তখন অনেক পরিবার কাউনের জাউ ভাত খেতেন। খাদ্যের মধ্যে আরও ছিল চিনা ও ভূরে। শহর থেকে এ খাদ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শহর এলাকায় পাড়ায় পাড়ায় ঢেঁকি ঘর ছিল। ঢেঁকিতে গমের ছাল ছাড়িয়ে গমের ও যবের জাউ রেঁধে খাওয়ার প্রচলন ছিল। আতপ চালের সঙ্গে পাকা বরই সিদ্ধ করে গুড় দিয়ে খাওয়া হতো। এখন সেসব স্মৃতি মাত্র। বাজারে মোটা চাল পাওয়া গেলেও সে ভাতে আর স্বাদ পাওয়া যায় না। দুঃস্থ পরিবারের শিশুদের সেই স্বাদু মোটা চালের ফেন ভাত খাওয়ানো হতো। এখন সে সব স্মৃতি মাত্র।
এই উর্বর মাটির পাবনায় যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতারও যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি খাদ্যাভাসেও বিবর্তন ঘটেছে। ১৯৬০ সালের পর থেকেই খাদ্যাভাসে একটু একটু করে পরিবর্তন শুরু হয়। এই পরিবর্তনের মূলে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি। যার ফলে খাদ্য উৎপাদন প্রবলভাবে বেড়ে যায়। পরবর্তীতে শুরু হয় সবুজ বিপ্লব। রকমারি রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় বা আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষের খাদ্যাভাস পাল্টাতে শুরু করে। অধিক ফ্যাট খাওয়া বর্জন করছেন অনেকেই। খাবার পদ নিয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। ভোক্তা সাধারণ বাজারে গিয়ে জৈব সারের সবজি খোঁজেন। রাসায়নিক সারের খাদ্য তারা সহজে নিতে চান না। ক্ষতির দিকটা চিনতে শিখেছেন। কালের বিবর্তনে ও অবস্থার চাপে পাল্টানো খাবার-দাবারে রান্নায় প্রাচুর্য বাড়লেও স্বাদ ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পারিপার্শ্বিক নানা রকম বদলে যাওয়ার মধ্যে খাদ্য তালিকায় যতটা বিয়োজন ঘটেছে ততটা নিম্নবিত্ত পরিবারে সংযোজন হয় নি। আজকের এই আর্থ সামাজিক সমাজনীতির টানাপড়েনের মধ্যে মানব সংসারের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বুরহানি কোমল পানীয়। মানুষ যত স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে ততই আঁশ যুক্ত বিশেষ করে শাক-সবজি ফলমূল খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। সুষম খাদ্য প্রণালীর সাহায্য নিতে চান সচেতন ব্যক্তিরা। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ আগে সারমুক্ত শাক পাতা খেত কুড়িয়ে। এ কথা মনে হতেই পন্ডিত মৃত্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’ গদ্য গ্রন্থের কথা মনে পড়ে যায়। ২শ বছরেরও বেশি আগে লেখা তাঁর এই বইয়ের ৪২ পৃষ্ঠায় এক দরিদ্র নারীর খেদোক্তি উল্লেখ আছে। ‘মটর, মসুর, শাক, পাত, শালুক, গুগলি, সিজাইয়া খাইয়া বাঁচি। খড় কুটা, কাটা, শুকনো পাতা, কঞ্চী, তুঁষ ও বিল ঘুঁটিয়া কুড়াইয়া জ্বালানি করি’। এখনকার সমাজে শ্রেণীগত ও বিত্তগত অবস্থান যাই হোক না কেনো- সবজির প্রতি আগ্রহ সবারই। খাবার তালিকায় সবজি এখন অবশ্যম্ভাবী একটি পদ।
শহরে আগে সব ধরনের শাক বিক্রি হয় নি। বাড়ির আশ পাশে এমনিই পাওয়া যেত অনেক শাক। যেমন মৌলবী কচু, লেটুস, নটেশাক ও খুরা শাক। কলমিকেও বাদ দেয়া যায় না। বাজারে এখন পুঁই, পালং, লাউ শাক, লাল শাক, থানকুনি, বেথুয়া, সরিষা শাক, কাটোয়া পাওয়া গেলেও হেলেঞ্চা, আদামনি, রাধা পূর্ণিমা, সুষনি ও ব্রাক্ষ্মী শাক পাওয়া যায় না। শহরে এর নামও শোনা যায় না। পদ্মার চর এলাকায় নুনখুড়ে শাক, লতা জাতীয় কেলনা শাক ও খান মান শাকের প্রচলন ছিল। টিকে আছে শুধু পাট, সাজনে মটর ও খেসারি শাক। মোচা বা থোড় চিংড়ি, লাউ আর কুচো চিংড়ির স্বাদের কথা ভোলার নয়।
চারশ বছর আগে লেখা চন্ডী মঙ্গল কাব্যে বাঙালির ভোজন সুখের বর্ণনা আছে। এ বর্ণনা দিয়েছেন কবি মুকুন্দরাম। তাতে নানা রকম সবজি, নানা রকম মাছ এবং পিঠার তালিকা আছে। রাধারমণ সাহার পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়, ‘দেশি মোটা বরণ ও আউস ধান জাত চাউল এ জেলাবাসীর প্রধান খাদ্য। আজকাল দেশি চাল কম পাওয়া যায়। মালদহ ও নবাবগঞ্জের চাউল সর্বত্র আমদানি হয়। নানা রকম মাছ ও ডাউল-তরকারি খাদ্যের উপকরণ। শহরে ঘি ক্রমশ মহার্ঘ জন্য সকলের পক্ষে উপযোগী নয়। রুটি লুচি এদেশের লোকেরা কম ব্যবহার করে। বিয়ের নেমন্ত্রণে লুচি মিষ্টি ব্যবহারের প্রচলন আছে।’
মানিক বন্দোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝিতে রূপালী ইলিশের ঘ্রাণ মাখিয়েছেন। সত্যিই, পদ্মার রূপালি ‘তেলুক’ ইলিশ পাবনাবাসীরও প্রিয় খাদ্য। বর্তমানে তা দুর্লভ। তেল ঢালা কড়াইতে পদ্মার বড় ইলিশ মাছ সাজিয়ে দিলে কুলকুল করে ঘাম দিয়ে উঠে আসতো তেল আর তেল। এখন তা স্বপ্ন। যারা খাদ্যরসিক তারা নদী তীরে গিয়ে ছোটো আকারের মাছ সংগ্রহ করে তৃপ্ত হন। জাম্বো ইলিশ তো পাওয়াই যায় না। ইলিশ রান্নার যে কয়েকটি পদ্ধতি আছে তা অনেকগুলির মধ্যে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, সরষের তেল আর হলুদ মেখে জাল দেয়া। পরদিন সকালে পান্তা বা মোটা চালের ভাতের সঙ্গে খাওয়ার যে রেওয়াজ চালু ছিল তা অনেক কমে গেছে। ইলিশ মাছের ডিম সরষে বাটা দিয়ে ভুনার যে স্বাদ তা কি আর পাওয়া যায়? ইলিশ দোপিয়াজি, ইলিশ মাথায় কচুর শাক, লাউ আর মাষকলাই ডাল কোনো মতে টিকে আছে।
পাবনাবাসী ১শ বছর আগে মাছ ছাড়া অন্য কিছু বুঝতো না। এ কথারও প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাস গ্রন্থে। উল্লেখ আছে, ‘এ অঞ্চলের মাঘ মাসে স্বরসতী পূজার সময় পরে মাঘী সপ্তমী তিথিতে ইলিশ মাছ পুজার চল ছিল’।
পদ্মার ইলিশ কমে আসছে। সুজানগরের সাতবাড়িয়ায় তিন কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যেত। এ খবর ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে এক কেজি ওজনেরও পাওয়া যায় না বলে খাদ্যরসিকদের দুর্ভাবনা। যা পাওয়া যায় তার দামও সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। পৌনে দুই কেজি ওজনের ইলিশ মাছ নিয়ে পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রায় আড়াই হাজার শব্দ ব্যবহার করেছেন। পদ্মা না গঙ্গার ইলিশ ভালো এ নিয়ে বির্তকে এপার বাংলাকে হারিয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গ তুলেছেন আরিচা ঘাটের। আগেকার ক্রেতা সাধারণ এক হালি করে মাছ কিনতেন সে কথাও তিনি লিখেছেন। ইলিশের পেটের মধ্যে যে তেলটা থাকে সেটা এবং পেটি ও গাদা অংশেরও ব্যবচ্ছেদ করেছেন।
বাদল দিনে খিচুড়িও প্রিয় হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজি, মাংস ভূনা বা ডিম ভাজি খাওয়ার প্রচলন আছে। ঈদের দিন অনেকে সেমাই ও খিচুড়ির সঙ্গে ঘি মাখিয়ে গরম গরম খেয়ে নামাজ আদায় করতে যান। চালের সঙ্গে গোটা মসুর সিদ্ধ করে খিচুড়ির মতো করে খাওয়া ৪০ বছর আগে যতটা ছিল এখন ততটা নেই। কিছু পরিবারের গৃহিনী এখনও মনের সুখে রান্না করতে পছন্দ করেন। তাদের রন্ধন শিল্প ঐতিহ্য মন্ডিত না হলেও পরিশীলনে শ্রেষ্ঠ। সাজ পোশাকে আচার আচরণে মানুষ যত আধুনিক হয়ে উঠছে, পৌর এলাকায় বসতি যত ঘন হচ্ছে ততই তৈরি খাবারের দোকান বাড়ছে। যাদের সামর্থ আছে তারা মাছ মাংস ফ্রিজে তুলে রাখছেন। তাদের সময় সুযোগ বুঝে সৃজনশীল রান্নার প্রতি মনোযোগী হন। অনেকে রান্না ফেলে টিভি সিরিয়ালে মন দেন। অনেকে জানেন, কল্পনা আর আবেগে রাঙানো রান্না এ জগৎ কে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় ফিরে পায়। দু-চারজন আছেন, যারা স্বভাবনিষ্ঠ ঢঙে মাঝে মধ্যে লুপ্ত প্রায় খাদ্য রেঁধে থাকেন। পাশাপাশি শাক ভাজি ভাতের সঙ্গে কাসুন্দি খাওয়ার চল আছে। আরো আছে কুমড়ো বড়ি যোগে মাছ-তরকারি।
আমাদের রান্নার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যে রন্ধন ধারা খুব একটা উল্লেখ নেই। উন্নত-অবনতর কথাতো অনেক পরের। লাফা বেগুন পোড়া ভর্তা ভাতের প্রচলন আজো আছে। পান্তার সঙ্গে পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের চল তো যুগ যুগ ধরে চলছে। সকলেই বোঝেন মরিচের মাহাত্ম্য। সাধ করে জিভের জ্বালায় উঃ আঃ করেন। লালা ঝরান। চোখের পানিও ঝরে যায়। তবু ভাতের সঙ্গে কাঁচা মরিচ খান। না পেলে লঙ্কার আচার। (এ প্রসঙ্গে একটি মর্মান্তিক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। ফরিদপুর উপজেলার বৃলাহিরী গ্রামে এক কৃষক (রবিউল) ভাত খেতে বসে কাঁচা মরিচ চায়। তা দিতে দেরি হওয়ায় তার স্ত্রী (আফরোজা) কে উপর্যুপরি ঘুষি মারে। এতে তার মৃত্যু হয়। সে দু-সন্তানের মা। এ ঘটনা ২০০৩ সালের ৮ জুলাইয়ে ঘটে।)
আগে ধানের খই, ঢ্যাঁপের খই দুধ দিয়ে খাওয়ার চল ছিল। ঢেঁকি ছাঁটা চিড়ে, আমন, আউশের মুড়ি আজ প্রায় বিলুপ্ত। চিড়ে-মুড়ি এখন মেসিনে তৈরি হচ্ছে। এতে না পাওয়া যায় স্বাদ, না থাকে খাবার আগ্রহ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৬ সালে দেশবাসীকে ঢেঁকি ছাটা চাউল ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘এ চাউলের মধ্যে যে পুষ্টিকর উপাদান আছে তাহা কোন ক্রমেই উপেক্ষনীয় নহে। চারিদিকে চাউলের কলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে। কলের ছাটাই চাউলে পুষ্টিকর উপাদান থাকে না। ফলে নানা সংক্রামক ব্যধির কবলে আমাদের পড়িতে হইতেছে।’ কবি যখন শাজাদপুরে থাকতেন তখন খাঁটি ঘি পাওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথ প্রতিমাসে ১৫ সের করে ঘি কলকাতায় পাঠাতেন তার স্ত্রী মৃণালিনীর কাছে। এ অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ যখন অবস্থান করতেন তখন তার খাবার-দাবারের আংশিক তথ্য পাওয়া গেছে। কলকাতা থেকে শিলাইদহে আসার সময় পতœী মৃণালিনী দেবী কবিকে অনেক কিছুই সঙে দিয়ে দিতেন। যেমন কামিনী চাল, সুপারি, পান, গুড়ের পাটালি, ঝুনা নারিকেল, রাই সরিষার তেল, আমসত্ব, আমচুর, ওষুধ, দুধ এবং মিস্টি। ১৮৯৮ সালের ১৩ জুন কবি কালিগ্রামে (পতিসর) রেল যোগে আসার সময় যা নিয়ে আসেন তার একটি তালিকা ও দর পাওয়া যায় জমিদারি হিসেবের ক্যাশ বইতে। উল্লেখ আছে রবীন্দ্র জীবনী গ্রন্থে মুগের ডাল ৩সের ৮ আনা। ঝোলাগুড় ৩ সের ৪ আনা। আটা ৫সের ১২ আনা ৬পয়সা। তিনি নিশ্চয় গুড় আর রুটি খেতে পছন্দ করতেন।
ভোক্তাদের মধ্যে বিশেষ খাবারের প্রতি বিশেষ অনুরাগ কোনো নিয়ম মেনে চলার কথা নয়। আবহমানকাল ধরে চলে আসছে যা তাই সর্বশ্রেষ্ঠ। রুচি এবং রস গ্রহণ এ জনগোষ্ঠীর অনেকটা নিজস্ব। এখানকার পন্ডিতেরা ভোজনকে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ মনে করেন নি বলেই খাদ্য খানা ও রাঁধুনীদের বিস্তৃত ইতিহাস লেখা নেই। নেই রাঁধিয়ে পাচক। শহরবাসীর রন্ধন প্রকরণের সামান্য খবর পাওয়া যায় পাবনা জেলা গেজেটিয়ারে। ‘শহরের বিত্তশালী এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা দুপুরে এবং রাতে উন্নতমানের সরু চালের ভাত খান। ভাতের সঙ্গে সঙ্গতি অনুযায়ী মাছ মাংস, সবজি, ডাল, দুধ, দই বিভিন্ন রকম দেশীয় ফলমূল এরা খান। রাতে এরা দুধ পান করেন।’ দিনের অন্য সময় নাস্তা হিসেবে আটা ও ময়দার তৈরি নানা রকম মুখরোচক খাবারের প্রচলন আছে। শহরের আশ-পাশ থেকে পর্যাপ্ত মাছ আমদানি হতো। আসতো পদ্মার জাম্বো ইলিশ। দৈনন্দিন খাবার তালিকায় তাই মাছ একটি সাধারণ উপকরণ হয়েছিল। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা আর্থিক সঙ্গতির অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। তাই তারা অপেক্ষাকৃত মোটা চালের ভাত খেতে বাধ্য হয়। দই, মাংস, দুধ এদের ভাগ্যে জোটে না। শাক-সবজী, আর ডাল এদের খাবার তালিকায় প্রধান উপরকরণ। গত শতকের ষাটের দশক থেকে গমের আটার ব্যবহার এই শ্রেণীর মধ্যে এখনও চালু আছে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় চালের সম্পুরক হিসেবে এরা গমের আটার রুটি খায়। যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি সে পরিবারে রুটি বানানো খুবই পরিশ্রমের ব্যাপার। বিশেষ করে গরমকালে এক কেজি ময়দার রুটি তৈরি করতে নাকানি চুবানি অবস্থা। অবশ্য ছোট পরিবারে রুটি খাওয়ার চল হয়েছে। খ্যাতিলাভ করা ৪টি কারখানার পাউন্ড রুটি বা ব্রেডও চলছে বেশ। মানুষ যত স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে ততই তাদের রুটি খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। চল ছিল ডাল রুটি খাওয়ার। কিন্তু ডালের দাম বাড়ায় এ খাবারও কমে এসেছে। উৎপাদন কমে গেছে খেসারী আছে মরিচ-পেঁয়াজ যোগে ‘চাপড়া’। পাবনা শহরে কেউ আর এখন ভুট্টার ময়দার রুটি খান না। ৬০ দশকে আগে রুটি খাদকদের অনেকে তাচ্ছিল্য করতেন। বলতেন, গরিবের খাদ্য রুটি। (এ প্রসঙ্গে ৪০ বছর আগে তৎকালীন সরকারের আটা-ময়দা চালুর প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা যায়। আটার ব্যবহার জনপ্রিয়করণ এবং বিদেশ হতে ময়দা আমদানি পরিমাণ কমাবার উদ্দেশ্যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকার পোস্তগোলায় ২টি ময়দার কল স্থাপন করেন। প্রথম কলটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আগে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়। ১৯৫৮-৫৯ এ ৪.১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার ও ২ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্প্রসারণ করা হয়। ২য় কলটি ১৯৫৮ সালের নবেম্বরে নির্মাণ কাজ শুরু করে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৯৬০-৬১ অর্থ বছরে শেষ করা হয়। এ ২টি মিলে বছরে মোট উৎপাদন ১৮ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রায় ১২ হাজার টন উৎপাদন হতো। এ ২টি কলের মধ্যে ১টিতে ৪ হাজার ৮শ টন গম পেশাই হতো। দেশে তখন যন্ত্র চালিত ৫টি বিস্কুট উৎপাদন ইউনিট ছিল। ১৯৬৪ তে ৬শ টন সেমাই ও ময়দা উৎপাদনের জন্য বিদেশি উদ্যোগে ২টি কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। এ দেশে খাদ্য রূপে গমকে আরও জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৪’র ৪ মে হতে গমের দাম সরকার কমিয়ে দেন। সরকারি গুদাম হতে সরবরাকৃত গমের দাম প্রতিমণ ১৪ টাকা হতে ১১ টাকা ৫০ পয়সায় হ্রাস করা হয়। খুচরা দোকানে তখন প্রতি সের ময়দা ৫৩ পয়সা এবং আটা ৩৪ পয়সা সের দরে বিক্রি হবে বলে সরকার ঘোষণা দেন মে মাসে। ধীরে ধীরে আটা-ময়দা চালুর পর কয়েক বছর হলো সুজির আটার চল হয়। এ খাদ্য এতটাই প্রিয় হয়ে ওঠে যে, চালের চেয়ে ময়দার দাম বেড়ে যায। বর্তমানে সুজির আটা ৪০ টাকা দরে বিকোচ্ছে।) বাঙালির খাদ্যাভাস পরিবর্তনে ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান স্কুল শিক্ষার্থীদের টিফিনের সময় বিনামুল্যে গমের জাউ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বিলাতি দুধের সঙ্গে সে এক মজাদার খাওয়ার ছিল। রান্না হতো স্কুলেই। কিন্তু এ চিন্তা ধারারও বদল হয়েছে। মাছে ভাতে পাবনাবাসীর এক ঘেয়ে খাদ্য জীবনে সৃজনশীল রান্নার তেমন প্রচলন ঘটেনি। শৌখিন রাঁধুনীদের কথা আলাদা। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ঈদ উপলক্ষে ঘরে ঘরে টুলে বা চৌকিতে বসে হাত মেসিনে সেমাই তৈরি করা হতো। চল ছিল ছই তৈরির। সেদিন আর নেই।
শহরবাসীর মধ্যে মসুর, মটর, ছোলা, মুগ, মাষকলাই, খাগকলাই, খেসারি ও অড়হর ডাল খাওয়ার প্রচলন আছে। আবহমানকাল থেকে ডালের বৈচিত্র্য অবাক করে দেয়। আউশ বা আমন ধানের চাল আর মাষকলাই ডাল-ভাত সদরের চরাঞ্চলে আজও অতুলনীয় খাবার। এক সময় গরিবের খাদ্য খেসারি ডাল প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তা অনেক কমে এসেছে। এ ডাল খেলে রোগ হয় তা সকলেই অবগত। কিছু পরিবার বছরে দুচারবার এ ডালের বড়া ভেজে খায় গন্ধভাদালিয়ার পাতা যোগে। ১৯৭৪ সালে আক্রার বাজারে খেসারি ডালের ময়দা ও গমের ভূষির চাপড়া খাওয়ার প্রচলন হয় নিম্নবিত্ত পরিবারে। কিছু দিনপর বাজার দর স্বাভাবিক হলে এ খাবারের বিলুপ্ত ঘটে। মটর ও মসুর ডাল রান্নার অন্যতম বৈশিষ্ট পাঁচ ফোড়ন প্রয়োগ। এতে রান্নায় একটুখানি স্বাদ ও বৈচিত্র্য এনে দেয়। করে তোলে মোহময়। কেউ কেউ ফোড়ন পছন্দ করেন না। কালোজিরে, মেথি, মৌরি, জোয়ান ও জিরে এবং শীতকালে ধনে পাতাও ফোড়নে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছোলা ও মুগডালে গরম মশলা দেয়া হয়। এছাড়া খাসির মাথা, কলিজা এবং মুগ ডালে মাছের মাথা দিয়ে রান্নার চল আছে। সাম্প্রতিককালে কাবলি ও এ্যাংকর ডাল আমদানি করা হয়েছে। যা খাওয়া যায় না। নিম্নবিত্ত পরিবার দেশি ডালের দাম বেশির কারণে এ ডাল খেতে বাধ্য হচ্ছে। বারোয়ারি ভোজনেও এ ডাল চলছে। যুগ যুগ ধরে কচি আম বা তেতুল দিয়ে গরম কালে মসুর বা মটর ডাল খাওয়ার প্রচলন আছে। আগে বরই টক বা টমেটো চাটনি ভাতের পাশে থাকতো। বর্তমানে কমে গেছে। মাষকলাই ডালে পেঁয়াজ-রসুনের ফোড়ন ছাড়া অন্য ফোড়নের প্রচলন নেই। টমেটো এক সময় চাটনিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা সালাডে মিশে যায়। আছে সজনে ডাটা, সরষে বাটা যোগে চচ্চড়ি ও ঢ্যাড়ঁস চচ্চড়ি। অনেকে ডাল পুইশাক দিয়ে চচ্চড়ি খান। প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে মাষকালাই ডালের রুটি। যা জাঁতায় পোষা হতো।
শীত মৌসুমে আগে একান্নবর্তী পরিবারে পাটালি দিয়ে পায়েস রান্নার ধুম পড়ত। আমাদের গর্ব পিঠে পায়েস। এটা একান্ত ভাবে সংসারের নিজস্ব জিনিস। বাইরের কোনো রেঁস্তরায় পায়েস পাওয়া যায় না। কিন্তু ঘরেও এটা দুলর্ভ হয়ে উঠছে। আজকাল ভেজাল পাটালি গুড়ের কারণে দুধ ফেটে যায়। দুধেও ভেজাল। পায়েস তৈরি করা হলেও স্বাদ পাওয়া যায় না। চিনি দিয়েও পায়েস তৈরি করা হয়। কিন্তু রাঁধুনীদের হাতে পায়েস রান্নার সময় নেই। তারা দুমিনিটে নুডলস তৈরি করতে ভালবাসেন। বৃহত্তর পাবনার শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া গ্রামের কায়স্থ বংশে ভূমিষ্ঠ হওয়া রাসসুন্দরী শতাধিক বছর আগে তাঁর লেখা ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে তখনকার সংসারের অনেক কথা জানিয়েছেন। ‘সেকালে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরের মা, বউ ও মেয়ে এখনকার দিনের মেয়েদের অপেক্ষা অনেক বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতেন। তারা শীতের সকালেও নদীতে গোসল করে ভেজা কাপড়ে বড় বড় কলসী ভরে পানি আনিতেন; ধান ভানিতেন, জাঁতায় ডাল ভাঙিতেন এবং অনেক লোকের জন্য রান্না-বান্না করিতেন’। কিন্তু এখন একান্নবর্তী পরিবার নেই। রান্না-বান্নাতেও স্বাধীনতা। তাই প্রতিযোগিতাময় জীবন প্রবাহে পিঠে পুলির প্রকরণ অনেকে ভুলে যেতে বসেছেন। শহরের ভাড়া বাড়িতে থাকা এবং স্থানীয় নিজস্ব বাড়িতে বসবাসরত একটি পরিবারের জন্যে রোজগার করছেন দুজন মানুষ। এ কারণে তাদের ব্যয় ক্ষমতা বেড়ে গেছে। তাই আগ্রহ এখন কেনা খাবারে। দ্বিতীয়ত চাকরি করতে গিয়ে রোজগেরে গিন্নির রান্নাঘরে সময় দেবার মতো অবসর তার নেই। বাইরে শ্রম দেবার কারণে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে রকম রকম রান্নার আগ্রহ থাকে না ছুটির দিন ছাড়া। সুতরাং কোনো মতে দু একটি পদ দায়সারা ভাবে রেঁধে রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চালানোর জন্যে ফ্রিজ তাদের বন্ধুর মতো কাজ করে। শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি। এসময় রান্নাঘরে একটুখানি মন দেন তারা। এর ব্যতিক্রমও আছে। যারা পরিচারিকার সহায়তা নেন তাদের কথা আলাদা। খাবারের কথা লিখতে গেলে স্মরণে আসে বহুভাষাবিদ পন্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থের কথা। তিনি সুলেমানী নুন, রুটি, ইলিশ মাছ ভাজা ও শামীকাবাবের কথা লিখেছেন। সকালে রুটি, মমলেট, পনির আর চা এর কথা উল্লেখ করেছেন কাবুলে বসে।
আবদুল গনি হাজারী মধ্যরাত্রির সূর্যতে লেখেন, আমরা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে পেটুক জাত। .......স্ক্যান্ডিনে ভিয়ার সবগুলি দেশেই তুমি দেখবে খানা পিনা এক প্রাত্যহিক উৎসবের ব্যাপার।’ তাঁর লেখায় আরচে ঘাট’ কবিতায় সস্তা লুচি, সন্দেশ, সু স্বাদু ডাব, জিরেন রস বিধবার পিঠের কথা পাওয়া যায়। আমাদের ঘরকুনো কবি ওমর আলী উড়ন্ত নারীর হাসি বইয়ের কয়েকটি কবিতায় খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করেছেন। বেগুন আলু ও জিয়েল মাছ গরম ঝোল মাখা ভাতের কথা বলেছেন। ‘রেখে গেলাম’ কবিতায় সিদ্ধ চালের ভাত তাতে বেগুন, আলু, কাঁচা মরিচ, ডাল কিংবা বেগুন আলুর সঙ্গে লাউ, কচু, পটলের সঙ্গে টাকি মাছের সুস্বাদু ঝোল। তিনি আতপ চালের রুটি, ঝোল করা মুরগির মাংসের কথাও তুলে ধরেছেন। নিত্য নৈমিত্তিক খাওয়ার জন্য নয়, মাঝে মধ্যে মুখ বদলাতে মাছ, মাংস বা ডিমের মশলাদার খাবারের চল কমে যাচ্ছে। ছোট-বড় সবারই এখন গ্যাস হবার ভয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে ডাবের পানি ছাড়া অন্য কোনো পানীয়র চল ছিল না। ছিল ঘোল। বাড়িতে গ্রীষ্মকালে লেবুর সরবৎ গুড় বা চিনি যোগে তৈরি করা হতো। কাঁচা আম থেতলানো সরবৎ, বেলের সরবৎ আর ছিল মিশ্রির সরবৎ। তরমুজ ও বাঙ্গির সরবতেরও প্রচলন ছিল। বর্তমানে মিকচার মেসিনের বদৌলতে এ ধারা বদলে গেছে। দোকানে দোকানে এখন ফ্রিজে রাখা শীতল পানীয় পাওয়া যায় বোতলে। আগে কাচের বোতল থাকলেও জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক। সর্বত্র মুদি দোকানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় পাওয়া যায়। ফেরিঅলার মাথা থেকে আইসক্রিম এখন দোকানের ফ্রিজে ঠাঁই নিয়েছে। পরিভ্রমণ করে রিকশা ভ্যানে। আছে ফ্রিজে রাখা আইসক্রিম। নেই কুলফি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের রকমারি কোলা সরবতের চাহিদা পূরণ করছে। দামি ডাব আর আগের মতো তরুণদের হাতে ওঠে না। পাশাপাশি রয়েছে স্যালাইন। কিছু কিছু বাড়িতে মা-বোনেরা দুধ এবং মিল্কমেড মিশিয়ে বাদাম কুচি দেয়া কুলফি তৈরি করেন গ্রীষ্মকালে। রৌদ্র তাপে যেমন জিভের স্বাদ বদল হয় তেমনি ঠান্ডা খাবারের প্রত্যাশায় উম্মুখ হয়ে থাকে গ্রীষ্মশুষ্ক মন। তাই এ সময় মুখরোচক আচার না চাটনি ভাতের সঙ্গে অনেকেই খেয়ে থাকেন।
সকালে আজকাল চা পানের সাথে অনেক পরিবার পরিচিত। সম্ভবত হার্ডিঞ্জ সেতু (১৯১৫) চালুর পর এ জেলায় কলকাতা থেকে চা আমদানি করা হয়।
চায়ের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় বোধ হয় ১৮৭৬ সালে। চায়ে আসক্ত করবার জন্যে রেল স্টেশনে টানানো বিজ্ঞাপন দেখা যেত গত দশকে। এশহরে যতগুলো দোকান আছে তার মধ্যে চা স্টলই বেশি। তাই বাড়িতে মেহমান এলে চা বিস্কুট দিয়েই আপ্যায়ন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কফির প্রচলন বেশি হয়। আশির দশকে চা দোকানে ও ভালটিনের প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু আগেকার দিনে মুড়ির মোয়া, ছোলার মোয়া, ক্ষুদের মোয়া, চিড়ে গুড় বা খই খাওয়ানো হতো। অনেক পরিবার সকালে নাস্তা করতো গুড়মুড়ি বা খাগড়াই বাতাসা মুড়ি। ছোলার বা যবের ছাতু পাকা আম দিয়ে খাওয়ার রেওয়াজও চালু ছিল। তা আজ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।
খাদ্য তালিকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লুচি। কি হিন্দু কি মুসলমান। উচ্চ বিত্ত পরিবারে ঘি বা ডালডায় ভাজা লুচি পরিবেশন করা হতো। ১৯৭৩ সালে জেলাপাড়ার একটি দ্বিতল বাড়িতে শত্তকত আলীর বউ ভাত উপলক্ষে অসংখ্য আমন্ত্রিতদের ছাড়াও আগতদের পর্যাপ্ত লুচি, বোঁদে, মিষ্টি আর টমেটো চাটনি দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। শহর এলাকায় অনেক দিন একথা চালু ছিল। হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে উৎসবে এখনো পনির খাওয়ার চল আছে। নানা উৎসব অনুষ্ঠানে বিয়ে বা ভোজবাড়িতে অর্থাৎ কমিউনিটি সেন্টারে বিরিয়ানি, পোলাউ, ভাত, মাছ, মাংস, রোস্ট, নিরামিষ আর দই এর আয়োজন থাকে। দইয়ের বদলে বুরহানি বা পানীয়র চল হয়েছে। কখনো বা দেয়া হয় মিষ্টি। এ প্রসঙ্গে সন্দেশের কথাও এসে পড়ে। সন্দেশ এর বিবর্তন ও তার সূত্রপাত হয়েছিল ৪শ বছর আগে। এর প্রধান উপকরণ ছানা আমাদের অগোচরে ছিল। ওলন্দাজ বা পর্তুগিজরা প্রথম ছানা তৈরি করতে শেখায়। সেই থেকে আমরা মিষ্টির সাথে পরিচিত হই। বিয়ে বাড়ি বা পিকনিকে ইলিশ বা রুই মাছ ভাজা দেয়া হতো। তার বদলে এখন রোস্ট। ভূনা মাংস আজকাল ফ্রাই হয়ে গেছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামীণ উৎসব অনুষ্ঠানে মোটা চালের ভাত, ডাল, নিরামিষ, গরু বা মহিষের মাংস এবং শেষ পর্বে দই কিংবা পাটালি গুড় বা চিনির পায়েস। এ ক্ষেত্রে রান্নার গুণ স্থির না থাকলেও পদ অনেকটা একই রয়ে গেছে।
আধুনিক রান্নার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনশীল জীবনের চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যম নেই। আমরা শুনতে পাই, জীবন কত পাল্টে গেছে। কত পাল্টাচ্ছে। মোবাইলের বদৌলতে গৃহিনী আজকাল আর টেবিলে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করেন না। মোবাইল দূর করেছে তার অপেক্ষার বিরক্ত। অতিরিক্ত খাবার নষ্ট হবার ভয় নেই। আছে ফ্রিজ। সবশেষে একথাও বলতে হয়, তখনকার মতো এখনও যাদের ফ্রিজ নেই সে সকল রাঁধুনীদের গুণ তাদের ঐতিহ্যে নয়, তাদের দক্ষতা অতি অল্প সময়ে ডিম ভাজি করে অতিথির সামনে পরিবেশন করা। এর বিকল্প রয়েছে নুডলস। এসেছে প্যাকেটজাত হালিম। এর পরে কি আসে সেটারই অপেক্ষায় আছেন পাবনাবাসী।
আতœীয় বাড়ি যাওয়ার সময় আগের মতন গলায় সুতলি বাধা মেটে হাঁড়ির ব্যবহার নেই। হাতে এখন সুদৃশ্য মান প্যাকেট। তাতে শুকনো বা রসে ডোবা মিষ্টি বহনের প্রচলন হয়েছে।
0 Comments: