
[লেখাটি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এ প্রকাশ হয়েছিল]
একাত্তরের আরেক প্রীতিলতা
পাবনায় রাইফেল হাতে
পুরুষের পোশাকে যুদ্ধ
করা কিশোরীর কথা
[১৯৭১-এ যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের উপর মেশিনগান, কামান, ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন কোন কিশোরী রাইফেল হাতে ছেলেদের পোশাক পড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে পারে- তা আজকের দিনেও অকল্পনীয়। কিন্তু ৫২ বছর আগে সেই দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছিলেন পাবনা শহরেরই ২০ বছরের কিশোরী শিরিন বানু মিতিল। তিনি ২৮ মার্চ টেলিফোন ভবন যুদ্ধ থেকে শুরু করে আতাইকুলা, কাঁশিনাথপুর এবং নগরবাড়ি ঘাটে পুরুষ বেশে যুদ্ধ করেছেন একটানাভাবে। এ মাসের ২ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ এবং শ্রদ্ধা জানাতে এ প্রতিবেদনটি রচনায় সম্প্রীতি প্রতিবেদক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসমূহের সহায়তা নিয়েছেন।]
শিরিন বানু মিতিল ১৯৫০ সালে ২ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরের নিউমার্কেট সংলগ্ন নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোয় আলোকিত ছিল তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্ম। নানা খানবাহাদুর ওয়াসীম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাবনার প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজসেবী এবং পাবনা পৌরসভার প্রথম সভাপতি ও জেলা বোর্ডের আজীবন সভাপতি। মিতিলের মা সেলিনা বানু ও বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ। বাবা ছাত্রজীবন থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হবার ফলে শিশু বয়স থেকেই মিতিল নিজেও ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তিনি ছিলেন পুরোপুরি কুসংস্কারমুক্ত শিক্ষার আলোয় আলোকিত। তার মামারা ছিলেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের কর্মী। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া শিরিন বানু মিতিলের রাজনীতিতে যোগদানও ছোটবেলাতেই। এ জন্য তাঁর মা তাঁকে নীহার কুমার সরকারের ‘ছোটদের রাজনীতি’ ও ‘ছোটদের অর্থনীতি’ পড়তে দেন। যদিও তখন ওই বই পড়া নিষিদ্ধ ছিল।

১৯৭১-এর ২৮ মার্চ পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে মিতিল ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল যমুনা নদীর তীরে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত নগরবাড়ি ঘাটে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচ- যুদ্ধ হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন যারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি এবং একমাত্র নারী ছিলেন শিরিন বানু মিতিল। কন্ট্রোল রুম ছেড়ে তিনি নগরবাড়ি ঘাটে হানাদারা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। ২৮ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনার কয়েক স্থানের প্রতিরোধ যুদ্ধে মিতিল ছিলেন অসীম সাহসী এক নারী যোদ্ধা।

চাচাতো ভাই জিঞ্জিরের কাছ থেকে মাত্র আধা ঘণ্টায় থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনা শিখে ফেলেন শিরিন বানু মিতিল। একজন নারী হয়ে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল ভীষণ দুঃসাহসিক কাজ। তাই শিরিন বানু মিতিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- তিনি পুরুষের পোশাক পরে পুরুষ বেশে যুদ্ধে যোগ দেবেন, যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।
পরবর্তীতে পাবনা শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে মিতিল ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। এর আগে পাবনার ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হয়। গাড়িতে জায়গা না হওয়ায় মিতিল ও তার এক ভাই থেকে যান কুষ্টিয়ায়। পরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের। তারা পুরুষবেশী নারী মুক্তিযোদ্ধা মিতিলকে খুঁজছিলেন। কিন্তু এভাবে তাকে হাতে পেয়ে তারা তাঁর ছবি ও সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর ভারতের দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন। এতেকরে পুরুষ সেজে মিতিলের যুদ্ধ করার সুযোগটি বন্ধ হয়ে যায়।
মিতিল ভারতে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত নারীদের একমাত্র সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গোবরা ক্যাম্পে যোগ দেন। পরবর্তীতে যুদ্ধের জন্য মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯নং সেক্টরে যুক্ত হন। তিনি ভারতের মাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং আশ্রয় নেওয়া শরনার্থীদের সহায়তার জন্য নানা কর্মে যুক্ত ছিলেন। নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় থেকে তিনি কয়েকজন নারীকে নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয় শিবির ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং এভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধা দল গঠনের কাজ করেন। তিনিই প্রথম ৩৬ জন নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। আস্তে আস্তে নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সদস্য সংখ্যা হয়েছিল ২৪০-এর ওপরে। সেখানে তিনি নিজেও প্রশিক্ষণ নেন, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকেন। অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন।
পাবনার প্রীতিলতাখ্যাত বীরমুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল ৯ নম্বর সেক্টরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিলেও যুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বা সনদের জন্য কোনো প্রকার আবেদন করেননি। তাই তাঁর কোনো সনদ হয়নি। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে শিরিন বানু মিতিল একটি উজ্জ্বল নাম।
তাঁর দীর্ঘ জীবনকালে পাবনায় অবস্থান ছিল খুবই অল্প সময়ের। এই সল্পকালীন সময়টুকুই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কাল। পাবনার ছাত্র রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ শিরিন বানু মিতিলকে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে।
২০১৬ সালের ২১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বীরকন্যা শিরিন বানু মিতিল। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। মৃত্যুকালে স্বামী মাসুদুর রহমান এবং এক ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। শিরিন বানু মিতিল কুমিল্লায় তাঁর স্বামীর দেশে অন্তিম শয়নে শায়িত আছেন।
0 Comments: