
এক.
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। পাবনা জেলার নিভৃত পল্লী সাদুল্লাপুর। সেই গ্রামে জনাব জসিম উদ্দিন এবং সগিরুন্নেছার ঘরে জন্ম তাদের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান ছিলো কন্যা আর দ্বিতীয়টি পুত্র। স্বভাবতই বাড়ি জুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে
যায়।
যদিও
চৈত্র
মাস
তবুও
শীতের
প্রচন্ডতা তখনও
কমেনি। চৈত্র
মাসে
জন্ম,
মা
আদর
করে
নাম
রাখলেন চৈতা।
সময়ের
পরিক্রমায় সেই
নাম
হয়ে
গেল
চৈতা
কাজী।
এক
ছেলে
আর
এক মেয়ে নিয়ে সগিরুন্নেছার সুখের সংসার। বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভালো নাম রাখলেন নঈম উদ্দিন। আদরের আতিশয্যে মায়ের মুখে নাম হয়ে গেল নঈমদ্দি। ‘ন’ বিলোপ পেলো। কখনও বা খোকা। সুদর্শন পুত্র-কন্যাকে নিয়ে বেশ আনন্দেই সগিরুন্নেছার দিন কাটছিলো। কিন্তু তার কপালে সুখ বেশি দিন সইলো না। নঈমের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, মেয়েটা চার বছর। তখনই মৃত্যুর করাল থাবা এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল জসিম উদ্দিনকে। দুই সন্তান নিয়ে বিধবা হলেন সগিরুন্নেছা।
তো এই ভড়াড়া গ্রামেই সগিরুন্নেছা পুত্র কন্যা নিয়ে সংগ্রামের জীবন শুরু করলেন। এই লড়াকু মহিলা তাঁর অসীম মনোবল নিয়ে সন্তানদের গড়ে তুলতে লাগলেন। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো তাঁর সন্তানেরা। তখনকার দিনে ভাড়াড়া গ্রামের আসেপাশে কোন স্কুল ছিলো না। স্কুল ছিলো ১৩ মাইল দূরে পাবনা সদরে। ১৮৯৪ সালে
জন্ম নেয়া পুত্র সন্তানকে ১৩ মাইল দূরের জেলা শহরের স্কুলে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছেন গ্রামের একজন মহিলা যার
কোন
বিদ্যাশিক্ষা ছিল
না।
কতটা
মানসিক দৃঢ়তা
থাকলে
এমন
সাহসী
কাজ
করা
সম্ভব
তা
সহজেই
অনুমেয়। সে
যুগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিবর্জিত একজন গ্রাম্যবধু সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তির আগে স্থানীয় হিন্দু পন্ডিতের কাছে নঈমের হাতে খড়ি হয়। তখন স্লেটের প্রচলন হয়েছে কিন্তু দরিদ্র নঈমের মায়ের স্লেট কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্য ছিলো না। অগত্যা কলাপাতায় শুরু হলো
বিদ্যাচর্চা। এভাবেই শুরু
হলো
চৈতা
কাজীর
বিদ্যা শিক্ষার গোড়াপত্তন।
একমাত্র পুত্র সন্তান তায় পিতৃহারা হওয়াতে সগিরুন্নেছার অত্যন্ত আদরের ছিলো, চৈতা দশ বছর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করেছে। যদিও অবাক হতে হয় তথাপি এটাই সত্যি। মাকে ঘিরেই ছিলো তার জগৎ, মাকে কেন্দ্র করেই তাঁর শৈশব কৈশোর এবং বেড়ে ওঠা।
দুই.
অত্যন্ত মেধাবী নঈম স্কুল জীবনে পড়ালেখা করেছেন প্রধান শিক্ষকের প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তায়। তাছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়েও সাহায্য করতেন তিনি। প্রধান শিক্ষকের এই সহযোগিতার সম্মান রেখেছেন নঈম উদ্দিন তার
মেধা
দিয়ে।
যখন
তিনি
হিন্দু পন্ডিতের কাছে
পড়ালেখা শুরু
করেন,
তখন
পন্ডিত মহাশয়
বেত
নিয়ে
বসতেন
এবং
প্রয়োজনে বেতের
ব্যবহার করতে
দ্বিধা করতেন
না।
কঠোর
অনুশাসনের মধ্যে
দিয়ে
চলতে
থাকে
তার
প্রাথমিক বিদ্যা শিক্ষা, আর
এই
শাসনের মধ্য
দিয়েই
বেড়ে
উঠতে
থাকেন
মেধাবী নঈম।
তিনি
ক্লাস
এইটের
পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগের মধ্যে
প্রথম
স্থান
অধিকার করেন
এবং
সেই
সময়ে
মাসিক
চার
(৪)
টাকা
করে
জলপানি (স্টাইপেন্ড) লাভ
করেন।
পরবর্তী তিন
বছরের
জন্য
এই
স্টাইপেন্ড তার
লেখা
পড়া
বাবদ
দেয়া
হবে।
তখনকার সময়ে
চার
টাকা
মানে
বিশাল
অঙ্কের টাকা,
তারপরও তিনি
তার
মায়ের
দুঃখ
মোচনের জন্য
দ্রুত
উপার্জনশীল হতে
চাইলেন। আর
এ কারণেই যে পড়াশোনায় তাড়াতাড়ি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন তাই করতে চাইলেন। তিনি জমির সার্ভেয়ার/আমিন সার্টিফিকেট পড়তে পাবনা টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেন। কিন্তু এখানে ভর্তি হলে মাসিক চার টাকা যে স্টাইপেন্ড পেতেন তা বন্ধ হয়ে যাবে। ইন্সপেক্টর অফ স্কুল তার স্টাইপেন্ড বিল কিছুতেই পাস করবেন না। তিনি নঈমকে বুদ্ধি দিলেন সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে ; নইলে সরকারি বৃত্তি দেয়া হবে না।
এখান থেকে জীবনের বড়সড় বাঁক বদল হলো নঈমের। তিনি ভর্তি হলেন পাবনা জেলা স্কুলে। বাড়ি থেকে ১৩ মাইল দূরের স্কুলে পড়া লেখা শুরু করলেন। প্রতিদিন সেই ভাড়ারা থেকে পাবনা যাওয়া আসা করতেন। সকালে যাওয়া আর বিকালে ফেরা। প্রতি মাসে বৃত্তির ৪ টাকা শুধু লেখাপড়ার পিছনেই ব্যয় করতেন না, বরং মাকেও তা
থেকে
সাহায্য করতেন। এই
বৃত্তি তিনি
ম্যাট্রিকুলেশন পাশ
করা
পর্যন্ত পেয়েছিলেন।
তখন তিনি ক্লাস এইটে পড়েন, মন দিয়ে লেখাপড়া করে মায়ের দুঃখ ঘোচানোই তার আরাধ্য। কবে মাকে একটু স্বচ্ছলতা দিতে পারবেন এই চিন্তা সবসময় তাকে তাড়িত করতো। বিধাতা অলক্ষ্যে বসে অন্য পরিকল্পনা করছেন এটা না জানতেন নঈম, না তার মা। ক্লাস এইটের পরীক্ষার পরে স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এলেন এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক। যাঁর বসবাস পাবনা শহরের রাধানগরে। পুরস্কার দিতে গিয়ে তার চোখ পড়লো এক সুদর্শন কিশোরের দিকে। মনে মনে ভাবলেন এই কিশোরের মাঝে সম্ভাবনা আছে। যতœ করে গড়ে তুলতে পারলে এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তার বড় মেয়ে জোবাইদার সঙ্গে মানাতো ভালো। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি, ওযাগাযোগ করলেন নঈমের অভিভাবক তার মায়ের সঙ্গে। নঈম যতদূর পড়তে চায় তিনি সমস্ত অর্থনৈতিক সাহায্য করবেন, বিনিময়ে নিজের জামাতা হিসাবে তাকে চান। রাধানগরের স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি কবির উদ্দিন খানের প্রস্তাবে সম্মত হলেন সগিরুন্নেছা। চলছিল ভালোই।
নঈম ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলেন ১৯১৫ খৃস্টাব্দে, ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। বন্ধুদের সঙ্গে ভর্তি হওয়ার পর তারা তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন কলেজ ত্যাগ করবেন অর্থাৎ লেখাপড়া বাদ দিয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেবেন। ব্রিটিশ আমলে সরাসরি এ এস আই বা দারোগার চাকরি, সে এক বিশাল ব্যাপার। এই সিদ্ধান্ত বদলে দিলো নঈমের জীবনের পথ।
কবির উদ্দিন খান যখন জানতে পারলেন তাঁর ভবিষ্যৎ জামাতার সিদ্ধান্ত, সে পড়াশোনা করবে না, পুলিশ সার্ভিসে
যোগদান করতে
চাইছে-
তখন
কবির
উদ্দিন খান
আর
দেরি
করলেন
না।
দ্রুতই মেয়ের
সঙ্গে
বিয়ের
বন্দোবস্ত করলেন। ১৯১৫
সালে
নঈমের
সঙ্গে
জোবাইদার শুভ
পরিনয়
সম্পন্ন হলো।
শুরু
হলো
যুগল
পথ
চলা।
তিন.
পুলিশ সার্ভিসে চাকরির আবেদনে করলেন নঈম উদ্দিন, ডাক পেলেন ইন্টারভিউতে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন এক ইউরোপীয়ান এস,পি। তিনি নঈম উদ্দিন কে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কেন পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করতে চাও?’ নঈম খুব স্মার্টলি উত্তর দিলেন, ‘আমি মানুষের ভালো করতে চাই। তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই এস,পি হিসেবে।’ এস,পি সাহেব নঈমের উত্তর শুনে যারপর নাই আনন্দিত হলেন। প্রসঙ্গত : বলতে হয়, তখনকার দিনে বাংলায় কোন ইন্টারভিউ নেয়া হতো না। নঈমের ইংরেজি উচ্চারণ আর সাবলীল উত্তর শুনে ইংরেজ এস,পি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একজন ইউরোপীয়ান ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনিও মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো উত্তর দিয়েছ ইয়াংম্যান।’ তাদের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ হয়ে গেলে নঈম উদ্দিন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলেন। ফাইনাল বা চূড়ান্ত ইন্টারভিউ অনুষ্ঠিত হলো জলপাইগুড়ি বেঙ্গল প্রেসিডেন্টসিতে, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ ছিলেন সেই
বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি
ইন্টারভিউ নিয়ে
নঈমকে
নির্বাচিত করলেন। একজন
সাব
ইন্সপেক্টর অফ
পুলিশ
পদে
তাকে
রাজশাহীর সারদা
পুলিশ
ট্রেনিং একাডেমিতে ৩ জানুয়ারি ১৯১৬ তে যোগদান করতে নির্দেশ দিলেন। নঈম উদ্দিনের ট্রেনিং একাডেমির ক্যাডেট নাম্বার ছিলো ১০৪। মোট ১২৫ জন ট্রেনি ক্যাডেটের মধ্যে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি ট্রেনিং শেষ করলেন। ট্রেনিং শেষে পরীক্ষায় তিনি দশম স্থান অধিকার করেন। অর্থাৎ ১২৫ জনের মধ্যে দশম। এতো ভালো ফলাফলের জন্য তাকে সারাজীবনের জন্য মাসিক ১৬ টাকা হারে ভাতা দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো, আর রিভলবার শ্যুটিং-এ তিনি অল বেঙ্গল পুলিশ সার্ভিসে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ জন্য তাকে গোল্ড
মেডেল
এবং
দশ
টাকা
করে
মাসিক
ভাতা
দেয়া
হয়,
যা
ছিল
সারাজীবনের জন্য।
এছাড়াও তাকে
একটি
সিলভার কালারড ইলেক্ট্রোপ্লেটেড ৫ চেম্বার ৩৫ চৎড়যরঃরাব ইড়ৎব রিভলবার দেওয়া হয়,যা নঈমের অফিসিয়াল পোশাকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল। পরবর্তীতে (যদিও এটা অনেক পরের ঘটনা তব্ওু এখানেই উল্লেখ্য) নঈমের প্রথম কন্যার প্রথম পুত্র সন্তান ১৯৭০ সালে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হলেন, তখন তাকে রিভলবারটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে লেকচারার ছিলেন নঈমের প্রথম নাতি
মেজর
আবদুস
সামাদ
রবি
(পরবর্তীতে মেজর
জেনারেল হন)। সেই সময় শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালি বলে সামাদ (রবি) সপরিবারে বন্দী হন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য দ্বারা। বন্দী হওয়ার কারণে নানার স্মৃতি জড়িত রিভলবারটি শত্রুর হাতে সমর্পণ করা সমীচীন মনে করলেন না। দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রিভলবারটি টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে ফেললেন।
চার.
নঈম উদ্দিন সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে ট্রেনিং শেষ করলেন। প্রথম পোস্টিং হলো দিনাজপুর। ১৯১৭ সালে শুরু হলো একাধারে চাকরি জীবন ও সংসার জীবন। তিনি দিনাজপুরের বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন সময় বদলি হয়েছেন। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে পার্বতীপুর, ঠাকুরগাঁও, রায়গঞ্জ, নবাবগঞ্জ, বালুরঘাট প্রভৃতি থানায় কাজ করেছেন। ১৯৩৭ সালে দিনাজপুর সদর থানায় তার পোস্টিং হয়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি বিভিন্ন থানায় চাকরি করেছেন এবং এ,এস,আই থেকে প্রমোশন পেয়ে এস,আই হয়েছেন। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রথম কন্যা সন্তান লাভ করেন। তারপর একে একে তিনি আরও দুই কন্যা সন্তানের জনক হন।
১৯২৫-১৯২৬ সালের দিকে তিনি স্পেশাল ডিটেকটিভ ট্রেনিং-এর জন্য দিল্লি যান। সারা ভারতবর্ষ থেকে ১২০ জন অফিসার সেই ট্রেনিং এ অংশ গ্রহণ করে। নঈম ১২০ জনের ভিতর সপ্তম স্থান অধিকার করে ট্রেনিং শেষ করেন। এই ট্রেনিং শেষে তিনি সফলতার সনদ ও একটি দামী হাত ঘড়ি পুরস্কার হিসেবে পান। দিনাজপুরের বিভিন্ন থানায় চাকরিকালীন সময়ে তিনি ভালো কাজের পুরস্কার স্বরূপ একাধিক দামী ঘড়ি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন। এর মধ্যে ছিল ওমেগা, ওয়েস্ট এন্ড, এবং বিভিন্ন সুইস মেক ঘড়ি। কিন্তু অতীব দু:খের বিষয় সেইসব স্মৃতি বিজরিত সম্মাননা সমূহ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লুট হয়ে যায়। শুধু যে ঘড়িগুলি নিয়েছে তাই নয় তার সঙ্গে বাসায় ব্যবহারের নানা তৈজসপত্র ও কাপড় সবই নিয়ে যায় দুস্কৃতকারীরা, সঙ্গে গোলার ধানও লুট হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে নঈম দম্পতি তার বড় মেয়ের সঙ্গে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাবনা সদর হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন তার অন্যান্য সন্তানেরা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, পাকশী,সিলেট চা-বাগান ও বিলাতে ছিলেন।
পাঁচ.
১৯৩০ সালে নঈম উদ্দিন যখন পার্বতীপুর থানায় কর্মরত তখন তার প্রথম স্ত্রী জোবাইদা খাতুন তিন কন্যা সন্তান
রেখে
পারলোকে গমন
করেন।
তাকে
পার্বতীপুর কবরস্থানে দাফন
করা
হয়।
তিনটি
শিশু
সন্তান নিয়ে
নঈম
খুব
বিপদে
পড়েন।
যদিও
সগিরুন্নেছা তার
সঙ্গেই ছিলেন
তথাপি
প্রয়োজন হয়
একজন
গৃহকর্তীর। সেই
মোতাবেক ১৯৩১
সালে
তিনি
বেলাল
উদ্দিন আহম্মেদ সাহেবের একমাত্র কন্যা
হামিদা বানুর
সঙ্গে
বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ
হন।
জনাব বেলাল উদ্দিন আহম্মেদ কালিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি,এ ডিগ্রি লাভ করে ব্রিটিশ বাংলা শিক্ষা বিভাগে চাকুরিতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন পাবনা শহরের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট। ১৯৫০ সালে দিনাজপুর
জেলা
স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর
গ্রহন
করেন
এবং
দিনাজপুর শহরেই
স্থায়ীভাবে বসবাস
শুরু
করেন।
প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন কন্যা সন্তান যথাক্রমে সামেনা, নাগিনা ও হাসিনা। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে
প্রথম
কন্যা
সন্তান সাকিনা (চুনি)। পরপর চার কন্যা সন্তান। নঈম উদ্দিনের মা শঙ্কিত এবং অসহায় বোধ করতে লাগলেন। যদি পুত্র সন্তান না হয় তবে নঈমের বংশরক্ষা কি করে হবে। এরইমধ্যে বড় মেয়ে সামেনার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি একজন পুত্র সন্তান লাভ করেছেন। এ সময় হামিদা বানু আবার সস্তান সম্ভবা হলেন। সগিরুন্নেছা আল্লাহর দরবারে একটি পুত্র সন্তানের জন্য কান্নাকাটি শুরু করলেন। তিনি আল্লাহর নামে মানত করলেন যদি তার পুত্রবধূ এবার একটা পুত্র সন্তান জন্মদান করেন তাহলে সেই পুত্র সন্তানকে দিয়ে ভাড়াড়া মসজিদ ঝাড়ু দিয়ে মুছে দেবেন। অবশেষে আল্লাহতায়ালা তার ডাকে সারা দিলেন। হামিদা বানু নঈম উদ্দিন দম্পতির কোল জুড়ে ঘর আলো করে জন্ম নিল এক পুত্র সন্তান। নাম রাখলেন পান্না (হাবিবুর রহমান) অর্থাৎ চুনির ভাই পান্না, রতেœর নামে নাম।
এরপর এলো আরও এক কন্যা সন্তান, নাম রাখলেন সুলতানা বানু (অনি) তারপর তাসকিনা বানু (গিনি)। নঈম উদ্দিন ১৯৪০ সালে পুলিশ ইন্সপেক্টর হয়ে দিনাজপুর থেকে বদলী হয়ে এলেন রাজশাহীতে। সেখান থেকে নওগাঁয় বদলি হলেন ১৯৪৩ সালে তারপর পুনরায় বদলি হয়ে রাজশাহীতে এলেন ১৯৪৪ সালের শেষে। রাজশাহীতে এলেন প্রমোশন পেয়ে। হলেন ডেপুটি সুপারেনটেন্ডেন্ট অফ পুলিশ (উঝচ) পদে। তারপর ১৯৪৭ এ বদলি হলেন ময়মনসিংহে। তখন তিনি এডিশনাল সুপারেনটেনডেন্ট অফ পুলিশ। ১৯৪৭ সালের কথা। এর মধ্যে লাভ করেছেন দুই পুত্র ও এক কন্যা। পুত্র কাজী কামরুজ্জামান (মুক্তা) ও কাজী হামিদুজ্জামান (মিণ্টু) আর কন্যা তাহমিনা বানু (মিনু)। ময়মনসিংহ থাকা কালেই তিনি সুপারেনটেনডেন্ট অফ পুলিশ (ঝচ) পদ মর্যাদায় কাজ করেছেন। এরপর তিনি আরও এক কন্যা সন্তানের পিতা হন। তাহমিদা বানু (বাচ্চি)। পুলিশ সুপার (ঝচ)
থাকাকালীন ১৯৫২
সালে
তিনি
অবসরে
যান
এবং
পাবনা
ফিরে
আসেন।
পাবনা
ফিরে
আসার
পরে
তিনি
আরও
এক
কন্যা
সন্তান লাভ
করেন
তার
নাম
রাখলেন শারমিনা বানু
(টুকুন)।
ছয়.
পাবনা শহরের পৈলানপুরে ইছামতী নদীর পারে ১৭ কাঠা জমির উপর ৫ কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি বানিয়ে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং মা সগিরুন্নেছাসহ বসবাস শুরু করেন। এই বাড়িতে ঢেকিঘর, রান্নাঘর, কুয়োতলা, গোয়াল ঘর ছিলো। নঈম আজন্ম খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। গরু ছিল তার প্রিয় পশু। চাকরি জীবনে তিনি বাড়িতে সবসময় কুকুর, বিড়াল ও গরু পুষতেন। অবসরজীবনিও তার ব্যত্যয় হয়নি। জীবনভর যবের বার্লি দিয়ে সকালের নাস্তা সম্পন্ন করতেন। দুপুরে ভাত ডাল মাছ সব্জি দৈ খেতে পছন্দ করতেন। পূর্ণিমা রাতে তিনি রুটি, সব্জি ও ডাল খেতেন। সে রাতে আমিষ বাদ। জীবনে গরুর মাংস খাননি। বিড়ি সিগারেট, চা ছুঁয়েদেখেন নাই। তবে পানের প্রতি আসক্ত ছিলেন।
গরু তার প্রিয় প্রাণী ছিল। নিজ হাতে গরুর যতœ নিতেন। এমন কি যখন ময়মনসিংহে এস,পি ইন চার্জ ছিলেন তখনও অফিস থেকে ফিরে ইউনিফর্ম চেঞ্জ করেই গরুর দেখভাল করতেন এবং গরুকে খাবার দিতেন।
মাতৃভক্ত নঈম ১৯১৬ সালে মাকে নিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৫২ সালে ছেলে এবং তার পরিবারের সঙ্গে অর্থাৎ পুত্র, পুত্র বধু, নাতি নাতনীর মাকে নিয়েই পাবনার নতুন বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন। কিন্তু এরপর সগিরুন্নেছা আর বেশি দিন বাঁচেন নাই। ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রিয় খোকাকে রেখে অনন্তলোকে পারি জমান। পাবনা
থেকে
প্রিয়
চৈতার
হাত
ধরে
শুরু
করেছিলেন সেই
পাবনাতে ফিরে
এসেই
তাঁর
যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্রিয় মাকে হারিয়ে ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি স্ত্রী পরিবেষ্টিত থেকেও নি:সঙ্গ একাকী হয়ে পড়েন তিনি। মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান সেই কোন ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছিলেন সে কথা এখন আর সেভাবে মনে পড়ে না, মা-ই ছিল তাঁর সর্বস্ব। আজীবন শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়ে গেছেন। তার সন্তান সংখ্যা মোট বারো জন। তিন ছেলে আর নয় মেয়ে। সন্তানেরা প্রত্যেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
১৮৯৪ সালের ১লা ডিসেম্বরে পাবনার সাদুল্লাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আর ১৯৯১ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহী শহরে মেয়ে প্রফেসর তাসকিনা বানুর কাছে হার্ট এট্যাকে সফল এবং বর্ণাঢ্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফিরে আসেন নিজ বাসভূমে। পাবনা শহরের আরিফপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। একজন সফল মানুষ আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় চির শান্তির দেশে গমন করেন, রেখে যান আলোকিত এক পরিবার, যেখানে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল এবং প্রতিষ্ঠিত।
সাত.
কাজী নঈম উদ্দিনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সাদুল্লাপুর তথা পিদিম জ্বলা গ্রাম থেকে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে তিনি
রেখে
গেলেন
তার
পরিবারের অসংখ্য সফল
মানুষ। নিজে
ছিলেন
এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। পা
রেখেছিলেন এডওয়ার্ড কলেজের সবুজ
চত্বরে, পরবর্তীতে সেই
মাঠে
পা
রেখেছে অর্থাৎ লেখা
পড়া
করেছে
নিজের
পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনী এবং নাতনির পুত্র-কন্যা।
৭০ বছর বয়সেও পাবনায় রাইফেল শ্যুটিং-এ পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পুত্র কন্যাদের তিনি শিক্ষিত করেছেন। ১২ সন্তানের মধ্যে ৮ জন সন্তানই গ্রাজুয়েট, এদের মধ্যে দুই কন্যা ডক্টরেট করেছেন। ওই দুই কন্যার একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অন্যজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আর একপুত্র হয়েছেন ডাবল এফ,আর,সি,এস।
কাজী নঈম উদ্দিনের পরিবারের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করছি। এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যই
যেন
একেকজন রতœ। আর এক জেনারেশন নয় তাদের সফলতা কয়েক পুরুষ ব্যাপী। সেই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত খান সাহেব উপাধিপ্রাপ্ত জনাব নঈম উদ্দিন ছিলেন একজন দানশীল এবং পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর এই দুর্লভ গুনাবলী পরবর্তীতে উত্তর পুরুষের মধ্যেও লক্ষ্যণীয়।
এই পরিবারের প্রথম কন্যা সন্তান সামেনা বানু। তিনি গৃহকর্ম এবং সূচীকর্মে নিপুণা ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
বেশীদূর না
করলেও
প্রচুর বইপত্র পড়েছেন এবং
সাংস্কৃতিক মনা
ছিলেন। অত্যন্ত সাহসী
আর
দানশীল এই
রমনী
হাজার
অভাব
অনটনের মাঝেও
তার
সাহায্যের হাত
সর্বদা প্রসারিত রেখেছেন। সংসারের অনটন
সন্তানদের বুঝতে দেন নাই। তাঁর আট সন্তান। প্রতিটি শিক্ষিত। সামেনা বানুর প্রথম সন্তান মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীর চীফ
অফ
জেনারেল স্টাফ
পদে
অধিষ্ঠিত হন
এবং
সম্মানের সঙ্গে
অবসরে
যান।
আরেক
পুত্র নৌবাহিনীতে চাকুরি করেছেন। তিন কন্যা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। তার এক কন্যা অতি সুন্দর গান করতেন, শিল্পকলা একাডেমিতে শিক্ষকতা করতেন, একইসঙ্গে তিনি সরকারি স্কুলেরও শিক্ষক ছিলেন। অন্য দুজন ঢাকার স্বনামধন্য কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর ছোট কন্যা অধ্যাপনা ছাড়াও অন্যান্য গুণের অধিকারী।
লেখালেখিতে তিনি
যথেষ্ট সাবলিল। এপর্যন্ত তার
তিনটি
বই
প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বিতীয় কন্যা নাগিনা বানু দ্বিতীয় শিশুর জন্মকালে মৃত্যু বরণ করেন। তৃতীয় কন্যা হাসিনা বানু (ননী) নিজগুণে গান শিখেছিলেন, গাইতেন চমৎকার, সূচীকর্যে নিপুণা এবং রন্ধন শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। তার হস্তলিপি ছিল অতীব সুন্দর, স্বচ্ছ যা দেখে লোকে প্রশংসা করতো।তাঁর সাতজন পুত্র কন্যা। ছয়জনই এম,এ পাশ করেছেন।
চতুর্থ কন্যা সাকিনা বানু চুনি। আই,এ পাশ করার পর বিয়ে হয়,তারপর আর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেন নাই। তবে পারিবারিক পরিবেশের কারণে প্রচুর বইপত্র
পড়েছেন। এবং
একজন
বিদগ্ধ নারীরূপে সমাজে
স্থান করে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় সূচীকর্মে নিপুণা ছিলেন। তিনি হস্তশিল্পের একটি ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নরওয়ের জাতীয় পোশাকের উপর সাকিনা বানুর সূচীকার্য সেখানে প্রশংসিত হয়। নরওয়ের শ্রেষ্ঠ ম্যাগাজিনে তাঁর তার সূচীকর্মের উপর প্রশংসা সম্বলিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর এক কন্যা বাংলাদেশের প্রথমসারির রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। পশ্চিম বাংলার অনেক অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এমনকি পশিম বাংলার শান্তি নিকেতনেও তিনি সংগীত পরিবেশন করেন। এ ছাড়াও চিত্রকলার উপর বিশেষ দক্ষতা থাকার কারণে তিনি দেশে-বিদেশে একক চিত্র প্রদর্শনী করেছেন।
পঞ্চম সন্তান পুত্র সন্তান কাজী হাবিবুর রহমান (পান্না) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি গ্রহণ করেন। তিনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হয়ে করাচীতে ছয় সপ্তাহের ক্রিকেট ট্রেনিং প্রাপ্ত হন। কর্মজীবন শুরু করেন ইস্পাহানি জুট মিল চট্টগ্রাম থেকে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বশেষে কর্পোরেশনের হেড অফিস মতিঝিল থেকে সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। তার একমাত্র কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোম ইকনমিক্স এ এম.এস,সি তে প্রথম
শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান
অধিকার করেন।
বর্তমানে আমেরিকার হেলথ
সার্ভিসে কর্মরত। এ ছাড়াও তিনি ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের হপকিনটন বোর্ড অব হেলথের ভাইস চেয়ারম্যান। শুধু তাই নয়, তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া
থেকে
এম.পি.এইচ-এ.এম.এস ডিগ্রিও অর্জন করেন।
ষষ্ঠ সন্তান অর্থাৎ পঞ্চম কন্যা ড. সুলতানা বানু ভারত থেকে মনোবিজ্ঞানে পি.এইচ,ডি করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। মনোবিজ্ঞান বিষয়ে একাধিক বই লিখেছেন যা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পঠিত হয়। তাঁর একপুত্র ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে রাশিয়া প্রবাসী অন্যজন কানাডা প্রবাসী।
সপ্তম সন্তান অর্থাৎ ষষ্ঠ কন্যা ড. তাসকিনা বানু (বৈবাহিক পদবী ফারুক) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনিও মনোবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন
করেছেন। বর্তমানে অবসর
জীবন
যাপন
করছেন।তাঁর প্রথম
কন্যা
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে অবসরে
গেছেন। ২০২৪
সালে
প্রথম
আলো
পত্রিকার ‘আলোকিত মানুষ’ প্রকল্প থেকে
(রাজশাহী বিভাগের দশজন)
গুণী
শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত করে।
দ্বিতীয় কন্যা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ
থেকে
বি.এস.সি এবং এম.এস.সি পরীক্ষায় ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়ে গোল্ড মেডেল পায়।একই বিভাগে প্রভাষক হিসাবে দুই বছর চাকরি করে। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। ড.তাসকিনা ফারুকের (বৈবাহিক কারণে ফারুক) একমাত্র পুত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর এবং সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
কাজী নঈম উদ্দিনের অষ্টম সন্তান পুত্র সন্তান হিসাবে দ্বিতীয় কাজী কামরুজ্জামান(মুক্তা)। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি,এস ডিগ্রি অর্জন করে বিলাত গমন করেন। গ্রেট ব্রিটেনের লন্ডনের গ্লাসগো এবং স্কটল্যান্ডের এডিনবারা থেকে এফ.আর.সি.এস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি লেখাপড়া করছিলেন সেটা ১৯৭১ সাল। এ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি লন্ডনে পাকিস্তানের বিপক্ষে এবং বাংলাদেশের পক্ষে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কাজী কামরুজ্জামানের অন্তর দেশের জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে। তিনি যুদ্ধে যোগদানের জন্য বিলাত থেকে কলকাতায় অবস্থিত তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরে মেজর ডাক্তার পদে একেবারে ফ্রন্ট লাইন যুদ্ধ হাসপাতালে ডিউটি করেন বা যোগ দেন। তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং বিজয়ীর বেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্ত, স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদেশের অসহায় মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্রে দূরাবস্থা তাকে ব্যথিত করে এবং তিনি আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। এদেশের দরিদ্র জনগণের সেবায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। দেশের মানুষের জন্য, পাবনার মানুষের তিনি স্বাস্থ্য সেবার ব্রত নিয়ে জনকল্যাণমুখী কাজে এগিয়ে আসেন। স্বল্প মূল্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল স্থাপন করেন। ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল নামে এ দেশের চিকিৎসা বঞ্চিত জনসাধারণের কাছে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজ এবং ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি হেলথ, বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ ছাড়া পাবনাতেও ২৫০ বেডের কমিউনিটি হাসপাতাল ও মাতা-পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে ৫০ সীটের হামিদা -নঈম নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। ঢাকা, পাবনা এবং অন্যান্য শহর ও গ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ক্লিনিক স্থাপন করে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা করেন এবং মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
কাজী নঈম উদ্দিনের নবম সন্তান, তৃতীয় পুত্র সন্তান
কাজী
হামিদুজ্জামান। ব্রিটিশ চা
বাগানের ম্যানেজার পদে
চাকরি
করতেন,
পরে
ডানকান ব্রাদার্সের মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসাবে অবসর
গ্রহন
করেন।
কাজী
হামিদুজ্জামানের চার
পুত্র। তারা
স্ব
স্ব
ক্ষেত্রে সফল।
দুই
পুত্র
ব্যাংকার, একজন
ইঞ্জিনিয়ার ও আরেকজন ডাক্তার।
কাজী নঈম উদ্দিনের দশম সন্তান কন্যা, তার নাম তাহসিনা বানু মিনু। ঢাকার হোম ইকনমিক্স কলেজ থেকে বি. এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার একমাত্র পুত্র সন্তান চীফ ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ে ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
নঈম উদ্দিনের ১১তম সন্তান কন্যা। নাম তাহমিদা বানি বাচ্চি। তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান
টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি
করতেন। তিনি
আর্লি
রিটায়ারমেন্ট নেন।
বর্তমানে বিশেষ
অনুরোধে আমন্ত্রিত হয়ে
ঢাকা
কমিউনিটি হাসপাতালের বোর্ড
এবং
বিশেষ
কমিটিতে যোগ
দিয়ে
বিজ্ঞ
উপদেশ
প্রদান করেন।
কাজী নঈম উদ্দিনের ১২ তম সন্তান এবং সর্বশেষ কন্যা শারমিনা বানু টুকুন। তিনি নবম কন্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে
সাংবাদিকতা বিষয়ে
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বেশ কয়েকবছর
কানাডায় বসবাস
করেছেন। বর্তমানে দেশে
ফিরে
ঢাকা
কমিউনিটি হাসপাতালে পরিচালক পদে
যোগ
দেন।
তার
বড়
পুত্র
মারা
গেছে।
ছোটটি
কানাডার জাতীয়
এয়ারফোর্সে কর্মরত।
এছাড়াও এই পরিবারে একাধিক সদস্য
ডাক্তার, আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, শিক্ষক,ডক্টরেট, এডভোকেটসহ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত সদস্য
রয়েছে। ৪ জেনারেশন ধরে উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে এবং পাবনা শহর আলোকিত করে
রেখেছে তাদের
সমাজ
সেবা,
নারী
শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা সর্বজন বিদীত। চিকিৎসা সেবায়
ঢাকা
কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্ট এক
লাইট
হাউস
বা
বাতিঘর হিসেবে আর্তমানবতার সেবায়
নিয়োজিত।
আট.
সগিরুন্নেছা এখন থেকে একশত ত্রিশ বছর আগে নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে লড়াই করেছেন। যে স্বপ্ন দেখেছিলেন,
ছোট্ট
চারা
গাছ
নিয়ে
অজ
পাড়াগাঁয়ের এক
বিধবা
রমনী
মহীরুহের স্বপ্ন বুকে
নিয়ে
প্রদীপ জ্বেলেছিলেন, আজ
এই
একবিংশ শতাব্দীতে এসে
তাঁর
স্বপ্ন বাস্তবে রূপ
নিয়েছে। অবাক
বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে
হয়
সেই
ছোট্ট
খোকার
পরম্পরা। নঈম
উদ্দিন, তার
আদরের
চৈতা
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ
দিয়েছে। নঈম
তার
প্রতিটি সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মানবিক মানুষ
গড়েছেন। প্রজন্মের পর
প্রজন্ম শিক্ষিত, সৎ,
মানবিক নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব
পুরুষ
প্রতিষ্ঠিত হলে
বেশির
ভাগ
সময়
দেখা
যায়
উত্তর
পুরুষেরা সাফল্য ধরে
রাখতে
পারে
না।
ইতিহাসে এমনটাই দেখা
যায়
এক
জেনারেশনের গর্বিত সাফল্য পরের
জেনারেশনে এসে
ব্যর্থ হয়ে
যায়।
কিন্তু নঈম
উদ্দিনের উত্তর
পুরুষেরা জেনারেশনের পর
জেনারেশন এখনো
সমাজে
মাথা
উঁচু
করে
স্বসম্মানে অধিষ্ঠিত।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পাবনা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে এক বালক তার বিধবা মায়ের হাত ধরে যাত্রা শুরু করছিলেন, বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে তিনি আলোকিত পরিবারের প্রধান হিসাবে ৯৭ বছর বয়সে পারলোকে পারি জমালেও
রেখে
গেছেন
তাঁর
উত্তর
পুরুষ,
যারা
মন
ও মননে আলোকিত। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ম্লান হয়নি সে উজ্জ্বলতা।
খিড়কীর দরজা থেকে বহুপথ পার হয়ে আজ তা সিংহ দরোজায় চির দীপ্যমান উজ্জ্বলতা নিয়ে অম্লান, প্রায় দেড় শতাব্দীর চন্দন সুবাসিত পথ পরিক্রমা।
[কৃতজ্ঞতা :কাজী
হাবিবুর রহমান
পান্না। কাজী
নঈম
উদ্দিনের প্রথম
পুত্র।]
0 Comments: