Headlines
Loading...
নাটকে পথিকৃৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোবাদ আলী

নাটকে পথিকৃৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোবাদ আলী

নাটকে পথিকৃৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোবাদ আলী

[লেখাটি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে সম্প্রীতি বাংলাদশ-এ প্রকাশ হয়েছিল]


নাটকে পথিকৃৎ বীর 
মুক্তিযোদ্ধা কোবাদ আলী

সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক জুড়ে

পাবনায় যিনি জাগরণ তুলেছেন

সনম রহমান


কোবাদ আলী। এক সময়ের সদাহাস্যজ্জ্বল সাড়া জাগানো নাট্য অভিনেতা। যদিও বর্তমান প্রজন্মের কাছে অপরিচিত এক নাম। কালের স্র্রোতে কালের হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁর নাম। পাবনার ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন পাবনা থিয়েটার-৭৭ এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। তাঁর অভিনয় দক্ষতা এখনও বয়স্কদের স্মরণ করিয়ে দেয় নাট্যমঞ্চের  গৌরবময় সেই দিনগুলোর কথা।

পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মো. ইয়াদ আলী ফুলজান বেগমের ছেলে কোবাদ আলী। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। আর এম একাডেমি থেকে কোবাদ আলী ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে একই কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধের দামামা বাজছিল ঠিক তখনই 'দাদুর স্বপ্ন  নামের একটি নাটকের বই জোগাড় করে চকচিরটের আকবর মেম্বারের বাড়িতে রিহার্সাল শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে। মেকাপের জন্য সময়ের নাটক পাগল শাহজাহান আলী হিরোক (পরবর্তিতে বাংলা ছবির চিফ অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর) কুঠিপাড়া থেকে এসে তাঁদেরকে মেকাপ করে দিতেন। তখন ছিলো প্রম্পটারের প্রম্পট শুনে শুনে অভিনয়ের সময়।

শুরু হয়ে যায় এলাকাতে নাটক, ভাষাণ যাত্রা, রূপবান যাত্রা। এসব অনুষ্ঠানের প্রম্পটার থাকেন কোবাদ আলী। তিনি আয়োজনের স্থানে হাজির হলেই সবাই আনন্দ প্রকাশ করতেন । পা ছুঁয়ে সালাম ভক্তি করে তারপর পালা গাইতে শুরু করতেন। বিরল সম্মান ছিলো প্রম্পটার কোবাদ আলীর।

১৯৬৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কোবাদ আলী সহযোগিদের নিয়ে ভাবলেন- ছুটির ফাঁকে অন্তত একটি নাটক করা যাক। সেইমত বাহাদুর স্কুল মাঠে আয়োজন করা হয় নাটক 'গায়ের বুকে’। তাতে 'ময়নার বাপ’ নামে পাগলের চরিত্রে অভিনয় করে এলাকাবাসীর ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন কোবাদ আলী। এভাবেই শুরু হয় তাঁর নাটকের জীবন।

এরপর প্রতিবছর ওই মাঠে নিয়মিত এক থেকে দুইটি করে নাটক মঞ্চায়ন হতে থাকে। নাটকের ব্যাপারে আশেপাশের গ্রামের মানুষের অনেক আগ্রহ ছিলো। কারণ সেখানে ওই সময় এবং তারও আগে পালা, জারি গান, মুর্শিদী গান বাউল গানের আসর বসতো। কাজের অবসরে নিজেদের মতো করে স্থানীয়রা এসব আসরের আয়োজন করতেন।

এডওয়ার্ড কলেজে এইচএসসিতে ভর্তির পর কলেজে 'সাগর সেচা মানিক 'সামনের পৃথিবী 'নীল সাগরের মুক্তা'শেষফুল প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করে শিক্ষকমন্ডলি শিক্ষার্থীদের প্রশংসা কুড়াতে সামর্থ্য হন কোবাদ আলী। তখন কলেজ ক্যাবিনেট থেকে বনমালী মঞ্চে দুইদিনব্যাপী নাটক 'কালো অধ্যায় মঞ্চায়ন করা হয়। এর মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন মিনা মিতা দুই বোন। সময় এডওয়ার্ড কলেজের ব্যায়ামাগার সম্পাদক ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল। এছাড়াও নানা দায়িত্বে ছিলেন শামসুল আলম, মোখলেছুর রহমানসহ অন্যান্যরা। 'কালো অধ্যায় নাটকটিকে ভীলেন চরিত্রে অপরূপ অভিনয় করেছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল। নাটকটির মুল চরিত্রে দর্শকমুগ্ধ অভিনয় করেছিলেন কোবাদ আলী। সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক আমিনুল হক। এই নাট্যানুষ্ঠানের ব্যাপারে যে সমস্ত শিক্ষক সহায়তা করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক সোলায়মান, অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক মজিবুর রহমান ভুঁইয়া, অধ্যাপক খালেকুজ্জামান, নেছার আহমেদ প্রমূখ শিক্ষক। তাঁদের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন কোবাদ আলী।

১৯৭১ সালের মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সবার মাথাতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না, সবার মুখে ছিল এক কথা স্বাধীনতা চাই। কোবাদ আলী বলেন, পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে আমরা পাবনা শহরের পশ্চিম এলাকাতে স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং নিয়ে গ্রামের যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের টিমের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ বাবু। সঙ্গে ছিলেন দুলাল, নসু, সাদী, মনজু, হাদী, মিজান, নীলুসহ অনেকে। আমার সঙ্গে এলাকার শামসুল আলম গান্ধি, আবদুল কুদ্দুস, আবুল হোসেন, আবদুস সাত্তার (বড়) মোবারক, আবদুস সাত্তার (ছোটো) সহ অনেকেই ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার জোগাড় থেকে শুরু করে রাতে রাতে ছোটো ছোটো অপারেশনে যুক্ত হতেন এঁরা সবাই।

শানিকদিয়ার যুদ্ধের কথা তুলে ধরে কোবাদ আলী বলেন, সারারাত অ্যাম্বুস করে ভোরের দিক থেকে আক্রমন হলো, টানা যুদ্ধ চলতে লাগলো। সকাল হবার কিছু আগে কালাইয়ের মাঠে মুক্তিযোদ্ধা সেলিম মারা গেলেন। তখন টিংকু-বাবলু এসএমজি তাক করে চেঁচিয়ে উঠেছিল, সেলিম ভাইয়ের লাশ না নিয়ে আমরা যাবো না এখান থেকে।

পরবর্তী প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কোবাদ আলী বলেন, স্বপ্নের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। আনন্দের জোয়ারে ভেসে আমরা জেলা স্কুল মাঠে এসে অস্ত্র জমা দিলাম। আমাদের সবাইকে তখন মুজিব বাহিনীর সার্টিফিকেট দেওয়া হলো।

কোবাদ আলীর ১৯৭১ সালে ডিগ্রী পরীক্ষা দেবার কথা ছিলো, কিন্তু পরীক্ষা হলো ১৯৭২ সালে। সে পরীক্ষায় পাশ করে কোবাদ আলী নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করেছিলেন। কারণ তিনিও গ্রাজুয়েটদের একজন। তিনি জানান, দেশ গড়ার ডাক এলো, নিজেকে সপে দিলেন দেশ গড়ার কাজে। সময় তার অবস্থান ছিলো বালিয়াহালটে। সেখানে রুহুল আমিনের (সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ আইজিপি হয়ে অবসর গ্রহণকারী) নেতৃত্বে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়েজিত হলেন। কাজে মকবুল হোসেন, আবদুল ওয়াহাব, আনিছুর রহমান, মোখলেছুর রহমান, বগাসহ অনেকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর শিক্ষকতায় জড়িয়ে পড়েন কোবাদ আলী। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন রুহুল আমিন, আর সহকারী প্রধান শিক্ষক হন আঞ্জুমান আরা। বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমএনএ আমজাদ হোসনের নামেআমজাদ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন কোবাদ আলী, নুরুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, রিমান আলী, দেবীতোষ রায়, আবদুস সাত্তার বিএসসি, মৌলানা আবদুল খালেক, শাহানা খাতুন বেবী, শাহজাহান আলী আনছার আলী। শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর চাকরি করেন কোবাদ আলী। তবে তাঁর নাটক থেমে ছিল না।

কোবাদ আলী জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কালো আইন তুলে নিলেন, মুক্ত হয়ে গেলো নাটকের ধারা। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ রিদ্দিক ক্লাবে নিয়মিত নাটকের চর্চা হতো। হেজাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে চলতো এই ক্লাব। তার ছোটো ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বাবু ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। সেই ক্লাবের ব্যানারে নাটক 'একটি পয়সাতে অভিনয় করে শ্রোতা দর্শককে মুগ্ধ করেন কোবাদ আলী। তিনি জানান, নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন আবদুর রশিদ মাস্টার।

কোবাদ আলীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পাবনা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দুরে দারিয়াপুর স্কুল মাঠে সময়ে নিজস্ব পরিচালনায় নাটকের আয়োজন করেছিলেন তিনি। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন কাজী মঞ্জুর হোসেন, মনোয়ার হোসেন, আসাদ, আতরসহ কয়েকজন। দোগাছীর কুলুনিয়া স্কুল মাঠে শাহজাহান আলীর পরিচালনায় স্থানীয় বিশিষ্টজন চুনুর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। অধিনায়ক ক্লাবেও নাটকে অভিনয় করেন। অবশ্য এখন এসব ক্লাবের অস্তিত্ব নেই। দারা আনিস নামের দুজন মুরব্বীসহ কয়েকজন পরিচালিত কাচারীপাড়ার নবীণ নাট্য সংসদের সুনাম ছিলো। সেখানেও 'শেষফল’ 'নীল সাগরের মুক্তা’ 'টিপু সুলতান’সহ বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন কোবাদ আলী। সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন’ নাটকটি নিয়ে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটির রঘুপতির চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন তিনি। এভাবে নাটক চলতে থাকার এক পর্যায়ে চায়ের আড্ডায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একটা নাট্য সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। কোবাদ আলী জানান, বন্ধু কাজী আবদুর রাজ্জাক দুলালের নেতৃত্বে কয়েকজন উদ্যোমী যুবকের চেষ্টায় ১৯৭৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর গঠন করা হয় নাট্য সংগঠন 'পাবনা থিয়েটার-৭৭’। সংগঠন সৃষ্টিতে ছিলেন কাজী আবদুর রাজ্জাক দুলাল, কোবাদ আলী, আতিয়ার রহমান, মোদাব্বের হোসেন রুপু, আবুল মোহসিন, আমিনুর রহমান সোনাই, বেলায়েত আলী বিল্লু, স্বপন, মুকুল, আবদুর রইচ খান, ইজিবর রহমানকচি, বাবু, আহসান, রতন, রাজ্জাক, আবুল কাশেম, আমজাদ হোসেন, কামাল, সিদ্দিক, আজিজল শামসুল আলম। পরবর্তিতে গণেশ দাস, আবদুুল্লাহ আল মাহমুদ মামুন, মোকারম হোসেন, নাজমুল হক বাবু, মহিউদ্দিন মিণ্টু, সোলায়মান আলী, সাব্বির, কবিরসহ অনেকে কাজ করেছেন। তাঁদের সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অধ্যাপক মশিউর রহমানকে সভাপতি কোবাদ আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে পাবনা থিয়েটার-৭৭ এর প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়।

সময় নাটক মঞ্চায়ন করার জায়গা থাকলেও রিহার্সেল করার কোনো জায়গা ছিলো না। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা সবার শ্রদ্ধাভাজন ওয়াজি উদ্দিন খানের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিসের একটি ভাঙাচোড়া পরিত্যাক্ত রুম  মেলে। সেখানে রিহার্সেলের জায়গা করা হয়। এরপর নাটক মঞ্চায়নের দিন ধার্য্য করা হয় ১৯৭৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর, নাটককিংশুক যে মরুতে এদিনই থিয়েটার-৭৭ এর জন্মদিন বলে ধরে নেওয়া হলো। এর আগে পাবনাতে যে সব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তার সবই হতো মঞ্চের পাশ থেকে প্রম্পটের মাধ্যমে। কিন্তু প্রম্পট ছাড়াই মঞ্চস্থ করা হয় 'কিংশুক যে মরুতে আর এর ভেতর দিয়েই প্রম্পট ছাড়া আধুনিক নাটকের মাইলফলক উন্মোচন করা হয় থিয়েটার-৭৭ এর নাট্যকর্মীদের উদ্যোগে।

১৯৮৩ সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য হয় পাবনা থিয়েটার-৭৭। পরবর্তিতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা মামুনুর রশিদের লেখা মঞ্চ নাটকওরা আছে বলেই’ মঞ্চায়ন করে ভূয়সী প্রশংসা পায় থিয়েটার-৭৭ নাট্যদল। প্রধান চরিত্র কালাপাহাড় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কোবাদ আলী, বৃদ্ধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কোবাদ আলীর স্ত্রী আয়শা খাতুন, শিশু শিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলো কোবাদ আলীর ছেলে কাওছার আলম মানিক, কনা আপা নামের চরিত্রে অত্যন্ত সুন্দর অভিনয় করেছিলেন মোসফেকা জাহান কনিকা (বর্তমান জেলা জজ আদালতের আইনজীবী গণশিল্পীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক) পরবর্তিতে ২০০১ সালে সংগঠনের লেখক অভিনেতা ইজিবর রহমানের রচিত নির্দেশিতপ্রেক্ষাপট’ নাটকটি বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হলে সেটি দর্শকদের ভূয়শী প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। নাটকটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কোবাদ আলী।

তিনি জানান, পাবনা থিয়েটার-৭৭ এর মঞ্চায়িত নাটক ৪৫টি, আর অভিনীত রজনীর সংখ্যা ১৪৫টি। সফল মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মাঝে 'কিংশুক যে মরুতে 'ফলাফল নিম্নচাপ 'আয়না 'রাজায় রাজায়'দিক চিহ্নহীন 'জনৈকের মহাপ্রয়ান 'হইতে সাবধান'  'চোর চোর 'কবর'ওরা আছে বলেই 'হযবরল 'অরক্ষিত মতিঝিল 'মৌচাক'মহামান্য ফজল মিয়া'ইদানিং আমরা সেপাই 'মুখোশ'ঈশ^ ফিরে যাও'পলাতক পালিয়ে গেছে 'ইলেকশন ক্যারিকেচার 'এখানে নোঙর'প্রেক্ষাপট 'আজরাইলের পোস্টমর্টেম 'পদক্ষেপ'অবক্ষয়'দ্যাশের মানুষ 'কেলা খেলা 'বর্ণচোরা '১৯৭১'ইডিপাস প্রভৃতি। উল্লেখিত নাটকগুলোর প্রায় প্রতিটি নাটকেই অভিনয় করেছেন কোবাদ আলী। নির্দেশনা দিয়েছেন ১৪টি নাটকের।দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখুন, নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলুন শ্লোগান নিয়ে থিয়েটার-৭৭ এর যে যাত্রা- তা আজো চলছে। শুধু পাবনার বনমালী মঞ্চ নয়, দেশের নানাস্থানে নাটক নিয়ে হাজির হয়েছে এই সংগঠনের নাট্যকর্মীরা। ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির আন্ত:জেলা নাট্য উৎসবসহ রাজশাহীর পদ্মা নাট্যমঞ্চ, রংপুর শিক্ষা সংসদ, কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি, সৈয়দপুর চোখ নাট্যদল, উল্লাপাড়া থিয়েটার, সিরাজগঞ্জে ভাষাণী মঞ্চে নাটক করে ভূয়শী প্রশংসা অর্জণ করেন কোবাদ আলীসহ সংগঠনের সব নাট্যকর্মীরা।

২০০১ সালে পাবনা থিয়েটার-৭৭ পাবনা ড্রামা সার্কেলের যৌথ উদ্যোগে পাবনাতে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের রাজশাহী বিভাগীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলামকে আহবায়ক এবং থিয়েটার-৭৭ এর কোবাদ আলী ড্রামা সার্কেলের সিরাজুল ইসলাম হিরাকে যুগ্ন আহবায়ক করে সফলভাবে সম্মেলন করা হয়েছিলো। যেখানে এসে উত্তরের সব জেলার নাট্য সংগঠনের কর্মীরা প্রশংসা করেছিলেন শৃঙ্খলাপূর্ণ আয়োজনের জন্য।

নাট্য অভিনেতা কোবাদ আলী ৫টি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। আশরাফুল ইসলামের রচিত নির্দেশিত চ্যানেল আইতে পরিবেশিত 'আমাদের গ্রাম আমাদের শেফালী’ ২৬ পর্বের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে টিভি দর্শকদের কাছে নিজের সুন্দর অবস্থান সৃষ্টিতে সামর্থ্য হয়েছিলেন কোবাদ আলী। নাটকটিতে কোবাদ আলীর স্ত্রী আয়শা খাতুন তাঁরই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও 'গুরু ভাই’ সিনেমাতে গুরু ভাই উপদেষ্টা চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোবাদ আলী। স্ত্রীকে অপারেশনের জন্য রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করে রেখেও তিনি অংশ নিয়েছেন বনমালী মঞ্চে নাটকে তার প্রিয়মুখ নাট্যবন্ধুদের সঙ্গে।

এছাড়া স্থানীয়ভাবে স্থানীয় কিছু বিজ্ঞাপনে কোবাদ আলী নানা চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে মডেল তারকা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেন। ২২৫ টাকা বেতনের শিক্ষকতার পাশাপাশি নাটকের সঙ্গে এভাবেই সময় দিতেন তিনি। এরকম একটা পর্যায়ে হঠাৎ করে তিনি শুরু করেন ঠিকাদারী ব্যবসা। ঈশ^রদী বিদ্যুৎ অফিসে এক বন্ধুর সহায়তায় ৬টি টায়ার টিউব সাপ্লাইয়ের কাজ পান। এখানেও বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। নয়নামতির হেজাজ উদ্দিন চট্রগ্রাম গেলে তার কাছে ওয়ার্কঅর্ডার দিয়ে দিলে তিনি সেগুলো কিনে পাঠিয়ে দেন। পরে অফিসে জমা দিয়ে বিল তুলে নেন কোবাদ আলী। সড়ক জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা পৌরসভাতে লাইসেন্স করেন তিনি। ১৯৮৩/১৯৮৪ সালে দুটি মাটির কাজ পেয়ে প্রচুর লোকসান হওয়ায় ছেড়ে দেন ঠিকাদারী ব্যবসা। সময় এডওয়ার্ড কলেজ গেটে পৌর মার্কেটে একটি দোকানের পজিশন নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই ১৯৮৪ সালে শুরু করেন ব্যবসা। দোকানটিতে স্টেশনারি মালামালসহ ফার্স্টফুড চালু করেন। নাম দেন মানিক ট্রেডার্স। এখন অবশ্য কলেজ গেটের সেই পৌর মার্কেটটি নেই। উন্নয়নের কথা বলে সেটি ভেঙে ফেলা হলেও পর্যন্ত কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে কোবাদ আলীসহ অসংখ্য ব্যবসায়ী নানা সংকটে জীবন পাড়ি দিতে বাধ্য হন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোবাদ আলীকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক তোফায়েল আহমেদ এবং সময়ের স্বরাষ্ট্র সচিবের স্বাক্ষর রয়েছে। এই সনদপত্র আজও খুব যতœ করে রেখে দিয়েছেন নাট্য ব্যাক্তিত্ব কোবাদ আলী।

১৯৭৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ¯œাতক  ছাত্রাবাসের আয়োজনে মো. আলাউদ্দিন রচিত বিনয় ভূষণ পাল পরিচালিত সামাজিক নাটকনীল সাগরের মুক্তা’তে শৈল্পিক অপরূপ নাট্যাভিনয়ে মঞ্চের প্রথম শিল্পী হিসেবে পুরস্কৃত হন কোবাদ আলী। ২০১১ সালের জুলাই রাজশাহী বিভাগীয় সম্মেলনে নাট্যকর্মে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের পক্ষ থেকে রাজশাহীর পদ্মামঞ্চেও কোবাদ আলীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে পাবনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কোবাদ আলীকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা-২০১৩ প্রদান করা হয়। নাট্যকলায় অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৭ সালে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। প্রধান অতিথি থেকে অনুষ্ঠানে নাট্য অভিনেতা কোবাদ আলীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতাত্তর পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমানে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি)

কোবাদ আলী আজও জড়িয়ে আছেন নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে। তিনি বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের আজীবন সদস্য, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ পাবনা জেলা শাখার আজীবন সদস্য। ১৯৯৫ সালে গঠন করা পাবনা জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন তিনি পাবনা চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ছিলেন   ১৮ বছর চেম্বারের একজন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ গ্রাম গোপালপুরে গঠন করেন গোপালপুর কৃষক সমবায় সমিতি, সদস্য হন উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির। পরবর্তিতে কর্মদক্ষতায় নিজের চেষ্টার সবটুকু ঢেলে দিয়ে সদর উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের স্থানীয় কৃষকদের উপকার করার মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালে তিনি সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

অত্যন্ত সদালাপী প্রবীণ এই নাট্য ব্যাক্তিত্ব পাবনা শহরের রাধানগরে নিজবাড়িতে বসবাস করেন। তার স্ত্রী আয়শা খাতুন এফপিএবিতে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেছেন। ছেলে কাওছার আলম মানিক একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন মেয়ে এক সময়ের সাংস্কৃতিক কর্মী শারমিন জাহান ফেন্সি গৃহিনী। মানিক পাবনার গণমঞ্চ নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন, আর ফেন্সি গণশিল্পী সংস্থা পাবনা আঞ্চলিক কমিটির একজন সঙ্গীত শিল্পী সংগঠক হিসেবে পরিচিতমুখ।

জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পাবনার নাট্য অঙ্গনসহ সাংস্কৃতিক পরিম-লকে সমৃদ্ধ করতে কাজ করেছেন কোবাদ আলী। তার অবদান জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে আজও শ্রদ্ধার জায়গা করে রেখেছে। অথচ বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরা চেনেনা কোবাদ আলীকে। উত্তরাধিকারের ভ্রান্তি এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে হারিয়ে ফেলা হচ্ছে অতীত গুণীজনকে, হারিয়ে ফেলা হচ্ছে সমৃদ্ধ অতীতকে। নাট্য ব্যাক্তিত্ব কোবাদ আলী তাঁর জীবনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি সুস্থতা কামনায় পরিচিতজন শুভানুধ্যায়ীদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন।



 

0 Comments: