[১৪ মে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে সম্প্রীতির প্রথম বর্ষ
২য় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশ হয়েছিল।]
পাবনার সঙ নৃত্য
শিবজিত নাগ
বাংলা বর্ষ বিদায়ের দিনে (চৈত্র-সংক্রান্তি) পাবনা শহরে সপ্ত নৃত্য অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। দলবেধে সঙ সেজে এক ধরনের ঢঙ করার এই নৃত্যানুষ্ঠান দর্শক পরিবেষ্টিত অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিশোর ও যুবকেরা সপ্ত নৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন ও অংশগ্রহণ করে। এক সময়ের সেই দিনগুলির মতো সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান আর এই শহরের আনন্দ-উৎসব হয়ে ওঠে না। উৎসবের না থাকলেও এখনও প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তিতে সঙ নৃত্যের কিছু অনুষ্ঠান হয়। হিন্দুধর্মের নানা উপাখ্যান, সামাজিক সমস্যা, বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা- বিশেষ করে ব্যাঙ্গ- রসাত্মক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়। একেক দল একেক ধরনের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ধারা বিবরণী রচনা করে। সাধারণত দলের একজন উচ্চস্বরে ধারা বিবরণী পাঠ করে এবং বিবরণী অনুসারে অন্যরা অভিনয় করে। বিভিন্ন চরিত্রে রূপদানকারী, এমনকী নারী চরিত্রের অভিনেতাদের ডায়ালগও (যদি থাকে) একই পাঠক পাঠ করে যায়, অভিনেতারা মুখ মিলিয়ে চলে। ব্যতিক্রমও হয় অর্থাৎ যার কথা সেই বলে এমনও হয়। নারী চরিত্রে ছেলেরাই মেয়ে সাজে। খোলা মাঠের এসব অনুষ্ঠানে মেয়েরা এখনও নয়, আগেও কখনও অংশ নিয়েছে বলে শোনা যায় নি। পুরো অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই নৃত্য থাকে। একক বা দ্বৈত নৃত্য একেবারেই যে থাকে না, তা নয়। তবে বেশিরভাগই দলনৃত্য দিয়ে অনুষ্ঠান সাজানো হয়। নানা উজ্জ্বল রঙের কাপড়, ঝকমকে কাগজ, শোলা ইত্যাদির তৈরি সাজ উপকরণ এবং সস্তা রং পাউডার ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী দিয়ে দলের সকলেই সপ্ত সাজে। দলের সাথে ঢাক-ঢোল, করতাল, বাঁশি, হারমোনিয়ম ও আর কিছু সাধারণ বাদ্যযন্ত্র থাকে। ধারা বিবরণী, অভিনয়, নৃত্য, বাজনা সব মিলিয়ে সপ্তদের গীতি নৃত্যনাট্য ধরনের অনুষ্ঠান পরিবেশনের প্রচেষ্টা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ ঢঙের নৃত্যের আধিক্যের কারণে প্রকৃতপক্ষে সগুদের সরল আনন্দ প্রকাশের নৃত্য অনুষ্ঠান হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দলের ভিন্ন অনুষ্ঠান হলেও বাজনায় ও নৃত্যে এক সাধারণ ছয় লক্ষ করার মতো। বাজনা কানে এলে এবং নৃত্য চোখে পড়লেই বোঝা যায় এটা পাবনার সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান।
শিল্পগতভাবে বলা যায়, ঐতিহ্যবাহী পাবনার এই সঙ নৃত্যানুষ্ঠান ঠিক সেভাবে বিবেচিত হয়নি কারও কাছেই। বিশেষ একটি দিনে পাবনা শহরের এক শ্রেণির মানুষের স্বতোৎসারিত আনন্দ প্রকাশের উদ্দাম হর্ষ অনুষ্ঠানের মর্যাদা নিয়ে এ সঙ নৃত্যানুষ্ঠান আজও টিকে আছে। লুপ্ত, বিস্মৃত বা শুধু স্মৃতিচারণের বিষয়ে পরিণত এখনও হয়নি। ঐতিহ্য বা শিল্পবিচারে বিশেষ মর্যাদা না পাওয়ার কারণেই হয়তোবা পাবনার সঙ নৃত্যানুষ্ঠান নিয়ে তত্ত্ব তালাশ করা হয় নি। কবে থেকে পাবনায় এর চল হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল, কে বা কারা চালু করেছিল, কার বা কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দিনে দিনে আনন্দ-উৎসবে রূপ পেয়েছিল, কেনই-বা এসব হারিয়ে যাচ্ছে তার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি বোধ করি একই কারণে। নানা স্থানে নানাভাবে
সঙ সেজে আনন্দ প্রকাশের চল আছে ঠিকই, তবে পাবনার সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান ভিন্ন বৈচিত্র্যের কারণে আলাদা আসন দাবি করতে পারে। বিশেষ এক দিনে প্রায় সারা দিন ধরে দলে দলে সপ্ত নৃত্যের এমন আনন্দ নৃত্য-উৎসব পাবনা ছাড়া আর কোথাও আছে কী? বাংলাদেশের আর কোথাও এমন আনন্দ উৎসব হয় বলে আমার জানা নেই।
পাবনার অনেকের স্মৃতিচারণমূলক কথায় ধারণা করা যায়, ঊনিশ শতকের বিশের দশকে সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠানের শুরু এবং তিরিশের দশক থেকে সাতচলিল্লশের দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর ধরে উৎসবের জমজমাট অবস্থাটা ছিল। সপ্ত অভিনেতা বাদ্য- বাদকসহ মোট বিশ থেকে পঞ্চাশ জন সদস্যের একেকটি নৃত্যদল গঠিত হতো। শহরে দশ-বারটি ছোট বড় দল একের পর এক অন্তত আট-দশটি খোলা মাঠে অনুষ্ঠান করে চলতো। তাদেরকে ঘিরে বিপুল দর্শক-শ্রোতা অনুষ্ঠান উপভোগ করতো। বাদ্যের বাজনা, নৃত্যের তালে দর্শকদের মন-প্রাণ ও যেন নেচে উঠতো। শিশুরা সারাদিন সপ্তদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াত। শিশু বয়সে পেছন থেকে হনুমান সাজা সঙের লেজ টেনে ধরার কথা এখনও ভুলতে পারেন নি বেড়ার মাছ ব্যবসায়ী পঞ্চান্ন বছর বয়সের হারাধন সরকার। এক সময় পাবনার ঐতিহ্যবাহী গেঞ্জি শিল্পের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হরিশ ঘোষ, বলাই ঘোষ, মুদি ব্যবসায়ী প্রফুল সাহা প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কয়েকটি বড় সপ্ত নৃত্যদলের খুব নামডাক ছিল। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ভূপেন রায়ের দশপূজা, দুর্গার রূপ নিয়ে সপ্ত নৃত্যে অংশ নেয়ার কথা এখনও অনেকেই প্রশংসার সাথে বলে থাকেন। হরিজনদের দলও কম যেত না। অনেকের মতে, তাদের দলই এক সময় শ্রেষ্ঠ দল ছিল। চৈত্র-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠান হলেও সপ্ত দলের মহড়া চলতো সারা চৈত্র মাস। মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তো সাজ সাজ ভাব লেগে যেত। সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শহরের আট- দশ জায়গায় মহড়া চলতো। তাই একজন যথার্থই বলেছেন, সপ্ত নৃত্য-উৎসব একদিনের হলেও সারা মাস ধরেই শহরে উৎসবের আনন্দ লেগে থাকতো। হ্যাঁ, বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাল অনুষ্ঠান করার আন্তরিক প্রতিযোগিতা চলতো।
এই চৈত্র-সংক্রান্তিতেই হিন্দুদের চড়ক পূজা হয়ে থাকে। পাবনায় চড়ক পূজার অংশ হিসেবে বিশেষ ধরনের পূজা উৎসব হয়ে আসছে। এই পূজা উৎসব হাজরা উৎসব নামে পরিচিত। সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান ও হাজরা একই দিনে অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেকেই সঙ নৃত্যানুষ্ঠানকে হাজরা উৎসবের অংশ হিসেবে মনে করে। তাই পাবনার মানুষের কাছে সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান 'সাজ হাজরা' নামে প্রতিষ্ঠিত প্রকৃতপক্ষে নৃত্যানুষ্ঠানের সাথে ধর্মীয় উৎসব হাজরার কোনই সম্পর্ক নেই। উল্লেখ্য চড়ক পূজা প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দুসমাজের এক শ্রেণির লোকের মধ্যে আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ভয় হরণকারী দেবতাকে তুষ্ট করার উৎসব হিসেবে চড়ক অনুষ্ঠানে ভয়-ভীতি দূর করার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির চল আছে। ভক্তবৃন্দ নানা ধরনের দুঃসাহসিক কাজ করে ভয় হরণকারী দেবতার আশীর্বাদ লাভের চেষ্টা করে থাকে। এ কারণে এ উৎসবের অংশ হিসাবে
সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শহরের আট-দশ জায়গায় মহড়া চলতো। তাই একজন যথার্থই বলেছেন, সঙ নৃত্য-উৎসব একদিনের হলেও সারা মাস ধরেই শহরে উৎসবের আনন্দ লেগে থাকতো। হ্যাঁ, বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাল অনুষ্ঠান করার আন্তরিক প্রতিযোগিতা চলতো
ভক্তবৃন্দকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে বা বরই ও খেজুরের কাঁটার মধ্যে লাফালাফি করতে দেখা যায়। অনেককে ঢাকের বাজনার তালে নানা রকম ধারালো অস্ত্র, মরা মানুষের হাড় ও মাথার খুলি, শ্মশানে ফেলে দেয়া মরা মানুষের ব্যবহৃত কাঁথা-বালিশ ইত্যাদি নিয়ে নাচানাচি করতে দেখা যায়।
চড়ক গাছের অনুষ্ঠানটির চলও একই কারণে- বিশ থেকে পঁচিশ ফুট লম্বা একটি শাল গাছের খুঁটি মাটিতে খাড়া করে পুঁতে দেওয়া হয়। এটাই হল চড়ক গাছ। আর একটি লম্বা কাঠদণ্ড এমনভাবে এর শীর্ষে লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে চড়ক গাছকে কেন্দ্র করে কাঠদণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর এক প্রান্তে একজনকে (গাজুনে সন্ন্যাসী) গামছা দিয়ে বেঁধে আরেক প্রান্তের দড়ির সাহায্যে শূন্যে চক্রাকারে ঘুরানো হয়ে থাকে। এক সময়ে নাকি সন্ন্যাসীর পিঠের চামড়ার মধ্যে বড় বাঁকানো লোহার কাঁটা বড়শির
মতো গেঁথে দেওয়া হতো। এ ধরনের অনেক অনুষ্ঠান চড়ক পূজা উপলক্ষে হয়ে আসছে। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার বোঁথরে এখনও উপরিউক্ত নানা উৎসব উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে হয়ে থাকে। সেখানে এখন বড়শি সন্ন্যাসীর পিঠে গেঁথে না দিলেও গামছা বা কাপড়ের সাথে লাগিয়ে দিয়ে শূন্যে চক্রাকারে ঘোরানো হয়। ঐদিন সেখানে বিরাট মেলা বসে। এই জাতীয় পূজা বিশেষ করে এর অঙ্গীভূত উদ্দাম অনুষ্ঠান হিন্দুসমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের সমাজে অবজ্ঞেয়। একইদিনে পাবনা চড়ক পূজা ও সপ্ত নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে আসছে বলেই হয়তো তথাকথিত অভিজাতশ্রেণির বলে পরিচিত লোকদেরকে উভয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে খুব কমই দেখা গেছে। চৈত্র-সংক্রান্তিতে পাবনা শহরের রাস্তায় কান পাতলে আজও সেসব দিনের সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের মনের কথা শোনা যায়।
0 Comments: