Headlines
Loading...
স্মৃতিতে অমলিন কবি  বন্দে আলী মিয়া

স্মৃতিতে অমলিন কবি বন্দে আলী মিয়া

 

স্মৃতিতে অমলিন কবি  বন্দে আলী মিয়া

কবি বন্দে আলী মিয়া


কবি বন্দে আলী মিয়া


স্মৃতিতে অমলিন কবি

বন্দে আলী মিয়া











আমিরুল ইসলাম রাঙা

আমার বয়স তখন সাত বা আট বছর আটঘরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বেরুয়ানে থাকি সড়াবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার বড় দুই ভাই তাঁরাও একই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন আমার মনে পড়ে যখন টু অথবা থ্রিতে পড়ি তখনই কবি বন্দে আলী মিয়া লেখা চোখে পড়ে শিশুকালে কবির লেখা আমাদের গ্রাম কবিতাটি পড়ে খুবই ভাল লেগেছিলআমাদের ছোট গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর- থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই- একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই এই কবিতাটি কতবার পড়েছি তার হিসাব নাই যত পড়তাম তত ভাল লাগতো

শিশুকালে আমার কাছে সেরা কবি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম তারপরেই ছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া খুব অপ্রিয় একটি সত্য হলো, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমার পছন্দ হতো না কারণ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা শব্দ আমার কাছে কঠিন মনে হতো এছাড়া অন্য কবিদের লেখা আমার কাছে তেমন ভাল লাগতো না তবে  ছোটবেলায় যত কবি থাকুক না কেন আমার মনের কাছে সবার উপরে ছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া সেটার প্রথম কারণ হলো, তাঁর লেখা আমাদের গ্রাম কবিতা আর দ্বিতীয় কারণ হলো, তিনি ছিলেন পাবনার কবি ছোটবেলায় আমার একটা স্বভাব ছিল- কোন্ কবির জন্ম কত তারিখে, মৃত্যু কত তারিখে এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন- এগুলো পরখ করে দেখতাম তখন বইপুস্তক বা পাঠ্য বইয়ে লেখকদের পরিচিতি থাকতো

দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়

কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখাগুলো খুঁজে দেখার স্বভাবও একসময়ে আমার মধ্যে সৃষ্টি হয় বড় ভাইদের বই  দেখতাম দেখতে দেখতে আবিস্কার করে ফেললাম কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখা উপরের সব শ্রেণীর পাঠ্য বইতে আছে আমাদের বাড়িতে এক পালিত ভাইয়ের ম্যাট্রিকের বইতে আবিস্কার করলাম 'ময়নামতি চর কবিতা তার আগে পেয়েছি 'কলমিলতা কবিতা পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জানতে পারি উনার সাহিত্য ভান্ডারে অঢেল মজুদ আছে যা পড়ে শেষ করা যাবে না এছাড়া আরেকটি ব্যাপার আমাকে আকৃষ্ট করতো সেটা হলো তাঁর নাম সব জায়গায় উনার নাম লেখা হতো 'বন্দে আলী মিঞা এই 'মিঞা কবে 'মিয়া হলো- তা আজও আবিস্কার করতে পারি নাই

১৯৬০ সালের শেষ দিকে আমার দাদা বড় দুই ভাই এবং আমাকে নিয়ে পাবনায় আসেন বড় ভাই তখন ফাইভ শেষ করে সিক্সে উঠেছে আটঘরিয়ায় কোন হাইস্কুল ছিলো না আমার দাদা তখন আটঘরিয়ার চাঁদভা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন দাদা ছিলেন যথেষ্ট সম্পদশালী সুপরিচিত ব্যক্তি দাদা সবাইকে উচ্চ-শিক্ষিত করবেন সেই লক্ষ্যে আমাদের পাবনায় নিয়ে আসেন প্রথমে বাড়ি ভাড়া তারপর বাড়ি ক্রয় করেন

বিদ্যালয়ে পাঠ্য বই বিতরণ উৎসব

প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করি আমার দাদা শুধু চেয়ারম্যান নয় উনি ছিলেন জোতদার লেখাপড়া  বেশি না জানলেও উনি ছিলেন পাবনা জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য তাঁর চিন্তা ছিল নাতীদের বিলেতে, মানে লন্ডনে লেখাপড়া করাবেন যাতে নাতীরা জজ ব্যারিস্টার হতে পারে সময়ে দাদা গ্রামের ত্রিশ বিঘা জমি বিক্রি করে পাবনা শহরে পৌনে এক বিঘা জমি কিনেছিলেন এমন দাদার বড় নাতী যখন আইএ পাশ করে পাকিস্তান আর্মী অফিসারে চান্স পান, তখন দাদার হার্টফেল করার মত অবস্থা তাঁর ধারণা ছিল আইএ পাশ করে কিসের অফিসার হবে? দাদার সেই শোক কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল যাইহোক দাদার বড় নাতী আর্মী অফিসার হিসেবে চান্স পাওয়ার এক বছরের মধ্যে উনি মারা যান দাদার সেই আইএ পাশ নাতী জজ হতে না পারলেও  মেজর জেনারেল হতে পেরেছিলেন

কবি বন্দে আলী মিয়া স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে দাদার কথা অনেক বলতে হলো তারপরে আরেকটু বলতে হবে ১৯৬০ সালে দাদা যখন আমাদের পাবনা নিয়ে আসা এবং রাখার চিন্তা করছিলেন, তখন আরেকটি বিষয় তাঁর মাথায় ছিল সেটা হলো ভালো এলাকায় ভালো বাড়িতে রাখতে হবে তখন ভালো এলাকা পাওয়া গেলেও ভালো বাড়ি পাওয়া খুব কঠিন ছিল শহরে এমন এলাকা ছিল যেখানে একশ বাড়ির মধ্যে একটি পাকা দালান বাড়ি ছিল না এমন চিন্তায় আমাদের জন্য বাড়ি ঠিক করা হলো রাধানগরে কবি বন্দে আলী মিয়া বাড়ি কবি নিজ বাসস্থান কবিকুঞ্জ ছিল পাকা বিল্ডিং আর আমরা পেলাম সেমি পাকা বিল্ডিং উনার মুল বাড়ির দক্ষিণ দিকের সেই বাড়িতে এসে উঠলাম

যখন পাবনায় আসলাম তখন আমার বয়স / বছর এই বয়সে তিনটি জিনিস দেখার কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না জীবনে প্রথম পাবনায় এসেছিলাম ১৯৫৮/৫৯ সালে বাড়ির মিয়া ভাইয়ের কাঁধে চড়ে পাবনা  স্টেডিয়ামে দেখেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত আসলাম, কিংকং, গোগা, মজিদ পালোয়ানদের কুস্তি দ্বিতীয় বার দেখি রূপকথা সিনেমা হলেহারানো দিন সিনেমা তারপর প্রথম দেখলাম কবি বন্দে আলী মিয়াকে কবি বন্দে আলী মিয়াকে যখন প্রথম দেখলাম তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম আর উনার চেহারা প্রায় এক রকম উনার বাড়িতে প্রায় দুইবছর ছিলাম উনি যে স্কুলে পড়তেন সেই আরএম একাডেমিতে ভর্তি হলাম দুই বছর পর একই পাড়ায় আমাদের নিজস্ব বাড়ি হলো উনার পরিবারের সবার কাছে আমরা ছিলাম ঘনিষ্ঠ এবং আপনজন উনার ছেলে-মেয়ে আমরা এখনও একই পরিবারের মত

১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন তাঁর মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত কবি বন্দে আলী মিয়াকে শত সহস্র বার  দেখেছি উনি রাজশাহী বেতারে চাকুরি করতেন বেশির ভাগ সময় রাজশাহীতে থাকতেন তবে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে পাবনার বাড়িতে আসতেন শনিবার পাবনায় এসে সোমবার চলে যেতেন পাবনায় আসলেই উনাকে  দেখতাম এছাড়া রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর পরিচালনায় ছোটদের অনুষ্ঠান 'গল্প দাদুর আসর শুনতাম উনার রচিত অনেক ছোটগল্পের বই পড়েছি নাটকের বই পড়েছি উনার আঁকানো অনেক ছবি দেখেছি উনাকে  দেখলে খুব রাসভারী মানুষ মনে হলেও উনার সঙ্গে যারা মিশেছেন তাঁরা বলতেন, উনি খুব রসিক এবং মিশুক ছিলেন

আমার দুর্ভাগ্য যে এমন একজন রসিক এবং মিশুক মানুষকে শত শতবার চোখের সামনে দেখলেও কখনো তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না হয়তো দুই-একবার সালাম দিয়েছি, কিন্তু উত্তর পেয়েছি কিনা তাও মনে পড়ে না কবি বন্দে আলী মিয়াকে নিয়ে আমার  অনেক স্মৃতি আছে তাঁকে কাছে পেয়ে কথা বলতে না পারার  বেদনা আছে তবে পরবর্তী জীবনে সেটা আর কষ্ট মনে হয়নি বরং উনাকে নিয়ে আমার কিছু কর্ম আছে যা আমাকে গর্বিত করেছে কবির মৃত্যুর নয় বছর পর ১৯৮৮ সালে আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদের সামনে আমার উদ্যোগে দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এভাবেই আমার স্মৃতিতে কবি বন্দে আলী মিয়া চিরকাল অমলিন থাকবেন

 

 

 

0 Comments: