
[লেখাটি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এ প্রকাশ হয়েছিল]
হামিদ রোডের যুবরাজ শিবজিত নাগ
অধ্যাপক শিবজিত নাগÑ পাবনার আবদুল হামিদ রোডের যুবরাজ। কারও কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় স্যার, কারও কাছে প্রিয় দাদা, আবার কারও কাছে শুধুই শিবজিত। আর আমার কাছে তিনি শিবজিতদা। শুধু আমার কাছে না, আমরা যারা তাঁর পরের প্রজন্মে পাবনার আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি, যাদের ঘাড়ে ছিল শিল্প-সংস্কৃতির ভূত, যাদের বিচরণ ছিল আব্দুল হামিদ রোড, তথ্যকেন্দ্র, প্রেসক্লাব, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, টাউন হল, আর আড্ডা ছিল প্যারাডাইস ও লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভা-ারে। আমাদের সবার কাছেই তিনি শিবজিতদা।
শিবজিতদা'কে আমি বলি আবদুল হামিদ রোডের যুবরাজ। যখন সেলফোন ছিল না, সকাল বিকাল সন্ধ্যা যখনই শিবজিতদা'কে আপনার প্রয়োজন হোক, এ রোডে আপনি দু'টি চক্কর দিলেই তাঁকে পেয়ে যাবেন। তারপরও না পেলে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভা-ারে ঢুকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি নিশ্চিত জেনে যাবেন তাঁর অবস্থান। আমাদের বেড়ে ওঠার কাল থেকে আজ অব্দি এটা দেখে আসছি ও জেনে আসছি বলেই আমি বলেছি শিবজিত দা' আব্দুল হামিদ রোডের যুবরাজ। অবশ্য এটা কেবল ভাবার্থে নয় আক্ষরিক অর্থেও। কেননা, তখন এ রোডের সাথেই দোকানে ঢাকা পড়েছিল তাঁর শতাধিক বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী বাসস্থান, যেটা রামকালী বাড়ি বলেই পরিচিত। এখন সুদূর ঢাকায় বসে শুনছি, ঐতিহাসিক সে বাড়ি ভেঙে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন।
শিবজিতদা'কে আমি প্রথম চিনি শিবানীদি'র বড়দা' হিসেবে। শিবানীদি শিবজিতদা'র ছোটবোন। সত্তর দশকের শেষ পর্যায়ে এডওয়ার্ড কলেজ বাংলা বিভাগে শিবানীদি আমার উপর ক্লাসের ছাত্রী। দেখতে সুন্দর ও সদাহাস্যোজ্জ্বল। সুন্দর গান করেন। তারও চেয়ে সুন্দর তাঁর অমায়িক ব্যবহার। দিদি'র গানেই প্রথমে মুগ্ধ হই, কারণ তখন আমারও ছিল সুরের নেশা। আর সেই সুবাদে তাঁকে দ্রুত দিদি বানিয়ে ফেলার প্রশ্রয়ও পাই। এরপর কলেজে এবং কলেজের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসাথে গান করি। রিহার্সাল করি। দিদি'র সাথে আন্তরিকতা আরও প্রগাঢ় হয়।
গানের পাশাপাশি যখন আমরা পাবনার একদল তরুণ মিলে গড়ে তুলি সাহিত্য সংগঠন 'কবিকণ্ঠ’, তখন পরিচয় হয় শিবজিতদা'র সাথে। উনি শিবানী দি'র বড়দা' মানে তো আমারও দাদা। তাঁর চেহারায়, কথায় ও আচরণে খুঁজে পাই শিবানীদি'র সাথে কী অদ্ভুত অদ্ভুত মিল। মুহূর্তে অনুভব করি শিবজিতদা' শুধু আমার নয় আমাদের তরুণ দলের সবার আত্মার আত্মীয়। এ ভাবেই তরুণ অধ্যাপক শিবজিত নাগ হয়ে ওঠেন আমার ও আমাদের সবার শিবজিতদা'।
তখন পাবনায় শিবজিতদা'র সমসাময়িক এবং অগ্রজদের মাঝেও ছিলেন অনেক গুণী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। কিন্তু আমরা তরুণদল কারও ছায়া খুঁজতে যাইনি। কারও সাহায্য-সহযোগিতাও চাইনি। এটাই ছিল আমাদের কবিকণ্ঠে-র সদস্যদের আদর্শ।
ওঁরা প্রেসক্লাবে বা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে দূর থেকে হয়তো আমাদের শব্দ ও বাক্যের ঝংকার শুনতেন। হামিদ রোডে প্যারাডাইস-এ আমাদের সশব্দ বিচরণ দেখতেন। হয়তো ভাবতেন এরা কারা, কী করে, এরাও কি ঘরছাড়া দলছাড়া উচ্ছন্ন-বালকদল! তাঁরা বাঁকা চোখে তাকাতেন, কিন্তু ডাকতেন না। কিছু বলতেন না। আর আমরা তো আদর্শগত ভাবেই তাঁদের ছায়া এড়িয়ে চলতাম। আমরা প্রতি শুক্রবার সবাই কবিতা হাতে হাজির হতাম তথ্যকেন্দ্রে কবিতা পাঠের আসরে। বাকি ছয় দিন বিকালে প্যারাডাইসের কর্নারে চলতো আমাদের চায়ের আড্ডা।
আমাদের এই কবিতা পাঠের আসরে অগ্রজদলের একজন হঠাৎ হঠাৎ আগন্তুকের মত হাজির হতেন, তিনি শিবজিতদা'। তিনি তখন রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা’র পাবনা সংবাদদাতা। তাঁর উপস্থিতি আমাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতো। আমাদের আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতা হয়তো তাঁকেও চমৎকৃত করেছিল, যে কারণে উনি স্বপ্রণোদিত হয়ে দৈনিক বার্তায় নিয়মিত কবিকণ্ঠে-র সংবাদ পাঠাতেন। এভাবেই শিবজিতদা'র সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন রচিত হয়ে। পত্রিকায় শিবজিতদা'র নিউজ দেখেই হয়তো ধীরে ধীরে তাঁর সতীর্থ ও মুরুব্বিরা আমাদের কর্মকা-ের প্রতি আস্থাশীল হতে থাকেন।
শিবজিতদা' বরাবারই ছিলেন অমায়িক ও উদার। আজ অনুভব করি, সেদিন আমাদের ইগো ছিল কিন্তু তাঁর ছিল না। আমরা ছিলাম তরুণ ও আবেগী। আর উনি ছিলেন মনে ও মানে বড় এবং আমাদের ছায়াদাতা। আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন।
শিবজিতদা' কখনও সাহিত্যচর্চা করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু উনি অল্পসময়েই হয়ে গেলেন আমাদের মতো তরুণ লিখিয়েদের পৃষ্ঠপোষক। এ ছাড়া কোথায় নেই তিনি! পাবনার সাংবাদিক সমাজে তিনি সংগঠক। উদীচী, গণশিল্পী সংস্থা পাবনা, এ সব সংগঠনের কোনোটার তিনি উপদেষ্টা, কোনোটার কর্ণধার। যেখানেই শিল্প-সংস্কৃতির আবহ সেখানেই তিনি আছেন। কোনো নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা নয়, কোনো স্বার্থ বা অর্থসিদ্ধি তো নয়ই। এই হলো আমাদের তারুণ্যের শিবজিতদা'। আজ চার পাঁচ দশক পরেও দেখি সেই একই মানুষ। একই স্বভাব। মাঝে কেবল দু'য়েকটা দাঁত হারিয়েছেন আর চুল পাকিয়েছেন এই যা। হয়তো ভেতরে ভেতরে আরও কিছু হারিয়েছেন, যার খবর আমরা জানি না। অথবা তিনি জানতে দেন না।
এরপর শুরু হয় জীবনের কঠোর বাস্তবতা। আমি এমএ পড়তে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হই। ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন ও ব্যস্ততায় পাবনার সাথে দূরত্ব বেড়ে যায়। অনেকের মতো শিবজিতদা'র সাথেও সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্যে ভাটা পরে। মাঝে মধ্যে ছুটিছাটায় পাবনা এলে যাদের সাথে দেখা করার তাগিদ অনুভব করি, তার মাঝে অবশ্যই শিবজিতদা একজন। সন্ধ্যার পর যাই প্রেসক্লাবে না হয় লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভা-ারে। দাদার সাথে বসে এক কাপ চা খাই। আমার শিবানীদি'র খবর পাই। মনে গভীর প্রশান্তি নিয়ে ফিরে আসি।
এভাবে ঢাকার জীবন শেষ করে পেশাগত কারণে চলে যাই কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে। দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। তখন তো আজকের মতো মোবাইল ফোন নেই। ছাত্রজীবনও নেই।
ছুটিতে বাড়ি আসি কালেভদ্রে। এর মাঝে একদিন
হঠাৎ শুনতে পাই শিবানীদি' অসুস্থ। ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি। ব্রেইন অপারেশন করতে হবে। অনেক বড় অপারেশন। হৃদয়টা মুচড়ে ওঠে। দূর থেকে প্রার্থনা করতে থাকি, হে মহান ¯্রষ্টা আপনি শিবানীদি'কে ভালো করে দিন।
১৫ই অক্টোবর ১৯৮৫ শিবানীদি'র অপারেশন। ভোরবেলা কুমিল্লা থেকে রওনা হয়ে সোজা পিজি হাসপাতালে চলে আসি। দেখি পরিচিত প্রিয়জন অনেকেই উপস্থিত। শিবজিতদা' উদভ্রান্ত। মুখে কথা নেই। আমি মনে মনে বলি, শিবজিতদা, আমি আছি আপনার পাশে। শিবানীদি যে আমারও বোন।
সকালে অপারেশন শুরু হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তবু শেষ হয় না। দশ এগার ঘন্টা ধরে অপারেশন করেন ডা. আহসান উল্লাহ ও তাঁর টিম। আট দশ ব্যাগ রক্ত লাগে। তারপর অপারেশন শেষ হয়। তারপর ঘটে সেই মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা, ঢাকা ভার্সিটির জগন্নাথ হলে টিভি রুমের ছাদ ধসে ৩৯ জন ছাত্রের মৃত্যু। শিবানী দি'র অপারেশনোত্তর শংকা নিয়ে আমরা তখনও পিজি'তে। তখনই একের পর এক মুমূর্ষু ছাত্রদের নিয়ে সবাই আহাজারি করতে করতে ছুটে আসতে থাকে। মনে সারাদিন শিবানী দি'র অপারেশনের চাপ, তারপর এই ঘটনা, সে দিনটির কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি।
এরপর দূর থেকে খবর নেই, শিবানীদি অপারেশনের ধকল কাটিয়ে ওঠেন, কিন্তু সুস্থ হন না। আমি আবার তাঁকে দেখতে আসি পিজি হাসপাতালে। শিবানীদি আমাকে চিনতে পারেন, কিন্তু কথা বলেন অসংলগ্ন, হাসেন অনাবশ্যক। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাই। তারপর একদিন খবর পাই, শিবানীদি সংসার শুরু করার আগেই এ জগৎ-সংসারের সব মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। সেই থেকে শিবজিতদা'র মাঝে আমি এখনও আমার শিবানীদি'কে খুঁজে পাই, দাদা কি তা জানে? জানে না। কারণ দাদাকে কখনও তা মুখ ফুটে বলিনি।
দাদা একবার আমাদের ঢাকার বাসায় একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে চেয়েছিলেন, মাঝে মাঝে পাবনা থেকে ঢাকা এলে সাময়িক থাকার প্রয়োজনে। আমি সব ব্যবস্থা করেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম ভালোই হবে, ঘন ঘন দেখা হবে, হয়তো একটু দায়িত্ব পালনেরও সুযোগ হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। পরে যে কোনো কারণে আবার দাদাই পিছিয়ে গেছেন।
মাঝে অনেকদিন দাদা'র সাথে আর দেখা নেই। আমারও পাবনা যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আগে দাদা ঢাকা এলে মাঝেমধ্যে খবর পেতাম, এখন তাও পাই না। মাঝে দাদা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সে খবরও পেলাম বেশ পরে।
জীবনের বাস্তবতায় আজ হয়তো আমাদের দৃষ্টিসীমার দূরত বেড়ে গেছে, কিন্তু মন তো এ বাস্তবতার অধীন নয়। তাই ইচ্ছে হলেই মনের চোখ দিয়ে দেখি, হামিদ রোডের ভিড় ঠেলে শিবজিতদা এগিয়ে চলেছেন প্রেসক্লাবের দিকে। তারপর প্রেসক্লাব থেকে রাতের আলো-আঁধারি পেরিয়ে যাচ্ছেন কোনো পত্রিকা অফিসে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভা-ার কিংবা পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা টাউন হল কিংবা বনমালী'র পথে। এই তো আপনার জগৎ। এ জগতে আপনি আরও অনেকদিন অবাধে বিচরণ করুন শিবজিতদা, আর সুস্থ থাকুন তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে, এটাই পরম প্রার্থনা।
0 Comments: