Headlines
Loading...
১৮৯০ : পাবনার পঠন-পাঠনের পরিপার্শ্ব ও পশ্চাৎপট

১৮৯০ : পাবনার পঠন-পাঠনের পরিপার্শ্ব ও পশ্চাৎপট

 

১৮৯০ : পাবনার পঠন-পাঠনের পরিপার্শ্ব পশ্চাৎপট








মুহাম্মদ নূরুন্নবী

এক.

সন্ধ্যা ডিসেম্বর ৩১, ১৯৯০ অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি জন্মের প্রথম শতকটাকে বিদায় জানালো পাঠকক্ষে পাশাপাশি, মুখোমুখি বসে পত্র-পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন কিছু বয়স্ক পাঠক স্কুল কলেজের ছাত্র পড়ুয়ারা সন্ধানী চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় বই পুস্তকের পঙ্তিমালায় ইস্যু কাউন্টারে চলছে বই দেয়া- নেয়া কেউ কেউ রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠায় ক্যাটালগের পাতায় পাতায় মনের মতো বই খুঁজতে ব্যস্ত কোথাও হৈ চৈ  নেই বড় এক পবিত্র নীরবতা যেন রীতির শাসন হয়ে নেমে এসেছে এখানে কতকালের ছবি, রীতি এই হিরন্ময় নীরবতা আজ মনে হচ্ছে, আমাদের পদ্মাপাড়ের পাবনায় 'অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি নিছক একটি গ্রন্থাগার মাত্র নয়ঃ স্মৃতির চন্দন মাখা এক সম্পন্ন ঐতিহ্যের কালজয়ী অহঙ্কার ঐতিহ্যকে নিয়েই এক এক রে একশ'টি বছর ১০ এর এই শেষ সন্ধ্যায় 'য়ে উঠেছে একটি ইতিহাস যেন এক ধূসর পান্ডুলিপি তাতে সময়ের কত পর্বান্তর, শাসন পাটের পট পরিবর্তন, মানচিত্রের রদবদল পদ্মা-মেঘনার ভাঙা-গড়ার পাচালী সুদুরের ছায়াপথ এঁকে পুঞ্জে পুঞ্জে বন্দী হয়ে আছে পাবলিক লাইব্রেরির একশ বছরে জনপদ পাবনার পঠন-পাঠন সংলাপ সংস্কৃতি যে উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে এলো, এতকাল পরে তার মুখবন্ধ গ্রন্থনার কাজ একেবারে অসম্ভব না 'লেও খুব একটা সহজসাধ্যও নয়

দুই.

অন্তত ১৮৯০ সালের মধ্যেই পাবনাতে আগ্রহী পাঠক সমাজের উদ্ভব ঘটেছে আধুনিক শিক্ষার ধাচে গড়া উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজ নোতুন জিজ্ঞাসার চাহিদা মেটাতে বই যে কেবল পড়ছেনই তা নয়, বই লিখছেনও, পত্র-পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন এবং স্বগত আত্মপ্রসাদ নিয়েই বলছি, পঠন-পাঠনের সীমিত বৃত্তে হিতবাদী গণমনস্কতা জাগরণ প্রত্যাশী স্বাদেশিক চেতনারও পরিচয় দিচ্ছেন জেলা শহর কেন্দ্রে স্বনির্ভর উদ্যোগে গ্রন্থাগার স্থাপন তারই এক বিশ্বস্ত দৃষ্টান্ত তখনও কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত না হলেও শহরে বালক বালিকাদের জন্যে দুটো পৃথক ইংলিশ স্কুল শিক্ষা পাঠক- বলয় সম্প্রসারণে নিবেদিত সে কালের অবিভক্ত ব্রিটিশ বঙ্গের পূর্ববঙ্গ, আমাদের বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে 'অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কালসীমায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাবোর্ড স্থাপিত হয়নি সুতরাং দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি পঠন-পাঠনের ধারা বিবর্তিত 'চ্ছে মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক  রেনেসা কার্যক্রমের প্রভাবে আনন্দের কথা, জীবন যাত্রার আধুনিকায়নের যুগ প্রক্রিয়ায় ইত্যবসরেই পাবনা কলকাতার সঙ্গে সময়োচিত সংযোগ স্থাপন করে নিয়েছে

বস্তুত ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব আবিষ্কার উদ্ভাবনের ফলশ্রুতিকে ইংরেজ শাসকবর্গ ঔপনিবেশিক স্বার্থে কলকাতা ভিত্তিক নেটওয়ার্কে প্রয়োগ করায় এদেশের সার্বিক কর্মকা-ের গতানুগতিক অবকাঠামোতে যুগান্তর যাত্রা সূচিত হয় রেলপথ ডাক ব্যবস্থার বিস্তার গুণটানা দাঁড়টানা নৌপথে বাষ্পীয় পোতের সদর্প আবির্ভাব কলকাতার সঙ্গে মফস্বল জেলাসমূহের যোগসূত্রকে করে তোলে গতিশীল লেন-দেনের মাধ্যম পণ্য থেকে মুদ্রায় স্থানান্তরিত হয়েছিল আগেই কোম্পানির আমলে 'কাইজারে হিন্দু মহারাণীর শাসন পর্বে উৎপাদন বণ্টন ভোগ-বিভাজনের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিন্যাস কার্যকর হওয়ায় মুদ্রা স্থানান্তর পদ্ধতিও প্রকার এবং প্রকৃতিতে দ্রুত পরিবর্তিত 'য়ে  মেহনতি জনতার শ্রান্ত হাত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সাহেবদেরহোম-এর দিকে দেশজ ভাগ্যান্বেষী মধ্যবিত্তের লক্ষ্মীর কৌটার দিকে দিক বদল করে কয়লার সদ্ব্যবহার করে দিল নোতুন সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটন নিয়ন্ত্রিত হারে হলেও কলকারখানা যা কিছু গড়ে উঠলো তা কলকাতা সংলগ্ন এলাকাতেই সুপ্রীম কোর্ট, বসলো হাইকোর্ট, ব্যাংক বণিকতন্ত্রের শক্তি ব্যাপ্তি দুই- বেড়ে গেল প্রায় সকল প্রকার শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অভ্যন্তরীণ বহির্বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত ' কলকাতাতে গোটা দেশ 'য়ে উঠলো লকাতার পশ্চাৎভূমি নবাবী আমলের হিন্দু-মুসলমান জমিদার শ্রেণীকে কক্ষচ্যুত করে দিয়ে কোম্পানির অনুগ্রহভাজন যেসব বেনিয়ান, মৎসুদ্দি, আমলা-গোমস্তা জমিদারী জেঁকে বসেছিলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরাও মোটামুটি কলকাতাতেই সুপপ্রতিষ্ঠিত অতএব ভূমি গ্রাম নির্ভর অর্থনীতি জীবন কাঠামোর বণিকতান্ত্রিক নগরায়নের এই কালসন্ধিতে  শ্রেণী স্বার্থ, সাম্প্রদায়িক স্বার্থ অসাম্প্রদায়িক দেশীয় স্বার্থে গঠিত বিভিন্ন সংস্থা, সমিতি এবং ধর্মীয়, শিক্ষা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রভূমি, বিচিত্র সংস্কারমূলক ভাবতরঙ্গে আন্দোলিত মহানগরী কলকাতার পথে পা বাড়ানো শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার-আচার জোত-জমি সংক্রান্ত প্রয়োজনে অন্যান্য জেলা শহরের মতো পাবনার পক্ষেও হয়ে উঠেছিল অনিবার্য অনিবার্যতায় বিদেশি উপনিবেশবাদ   দেশিয় দূরদর্শী ধনিক-বণিক-বেনিয়ান সংঘের শোষণ চক্রান্তের আঘাত যা- যেভাবে থাকুক নাকেন, পরোক্ষ কল্যাণের ভাগও নেহাত কম ছিল না পদ্মার ইলিশসহ পাবনার পাট কাঁচামাল কলকাতাগামী যন্ত্রদানবের আরোহী 'লেও বিনিময় মূল্য হিসেবে পাবনা চিন্তা-চেতনা-রুচি-অভ্যাসে নোতুন উপকরণ সংস্থানের সুযোগ পেল উৎপাদন সম্পর্কহীন মধ্যসত্ত্বভোগী-পরজীবী, বিত্তবান-মধ্যবিত্ত বিভিন্ন পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠায় পাবনা শহরেও নব্য শিক্ষিত নাগরিক পরিবেশ রচিত ' পরিবশে যদিও সদ্য দ্বিধামুক্ত মুসলমান একেবারে অনুপস্থিত নন, তবুও ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের পদচারণা ঊনিশ শতকের শেষ দশকেও বড় একটা স্বচ্ছন্দ 'য়ে ওঠেনি বলা বাহুল্য, নবজাতক পরিবেশের মুষ্টিমেয় অভিজাত জনগোষ্ঠীই পাবনাতে কলকাতা আশ্রয়ী রেনেসাঁর পথিকৃৎ: The Renaissance was not a popular movement, it was a movement of a small number of scholars and artists, encouraged by liberal patrons.' জেলার ইংরেজ আমলা-কর্মচারিদের সঙ্গে এঁদের ওঠা বসা ছিল কার্যোপলক্ষে এঁরা কলকাতায় যাতায়াত করতেন এবং সমকালীন ঘটনা প্রবাহ, চিন্তা-ভাবনা, লেখালেখি পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতা নিয়ে পাবনা ফিরতেন মুঘলাই বঙ্গের রাজধানী, বন্দর নগর ঢাকার সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ ছিল পারিবারিক ধর্মীয় সূত্রে রক্ষণশীল 'য়েও তাঁরা ইংরেজী ভাষা পাশ্চাত্ত্য শিক্ষাদীক্ষায় সামাজিক গাত্রোত্থান কামনা করতেন বৈষয়িক সিদ্ধি, ইংরেজ তোষণ অস্পষ্ট  দেশাত্মবোধ থেকে এঁদের মধ্যেই ধীরে ধীরে সবোধ দেশপ্রেম, রাজনৈতিকচেতনা এবং বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ অঙ্কুরিত হয়পেশামুখী শিক্ষালাভের তাগিদ- সেইসঙ্গে নিরপেক্ষ জ্ঞানার্জন স্পৃহায় জন্মান্তর পেতে থাকে খুব- সম্ভব, এই স্তরের শিক্ষক, উকিল, মোক্তার, চিকিৎসক অনুরূপ ধরনের বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিরাই বিত্তশালী জোতদার, জমিদার, ব্যবসায়িদেরকে অনুপ্রাণিত করে পাবনায় আধুনিক শিক্ষা পাঠচর্চার পথ, প্রতিষ্ঠান অভ্যাস গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন পাবনাতে কলকাতা-ঢাকা স্থানীয় প্রেস থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র সাময়িকী পাঠের নেশা জন্মে পুস্তকের ক্রেতা সংগ্রাহকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে বসতে থাকে বই বিকিকিনির দু'একটা 'রে দোকান অতঃপর সাধারণ পাঠকের সংখ্যা চাহিদা বৃদ্ধির অনুকূল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মীয় পেশাগত প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থ সংগ্রহের পথ ধরে স্থাপিত হয় গণ-গ্রন্থাগারঃঅন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি

তিন.

'Vox audita perit, littera scripta manet': মুখের কথা হারিয়ে যায়, লিখিত কথা থাকে লিখিত কথাই বই 'য়ে আসে পাঠকের হাতে, যায় গ্রন্থাগারে, শিক্ষালয়ে বা প্রশাসনিক, ধর্মীয় অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পাঠক 'তে পারে একজন শিক্ষার্থী, 'তে পারেন শিক্ষক এবং নানা ভিন্ন অবস্থানের মানুষেরও পাঠক হওয়াতে বাধা নেই বই সুমেরীয় রাজাদের ক্যুনিফরম লিপির মাটি-পাথরের চাকতি, মিশরীয় পুরোহিতদের হায়ারা গ্লিফিক- ডেমেটিক লিপির প্যাপিরাস,  সেমিটিক লিপির মোয়ারাইট শিলা বা বিভিন্ন আধুনিক বর্ণমালার ভূর্জপত্র, তালপত্র, চামড়া, তুলোট কাগজ উন্নতমান কাগজের আধারে স্টাইলাস, খাগ, পালক বা কঞ্চি কলমে লিখিত 'য়ে পান্ডুলিপি আকারে অথবা ছাপাখানায় মুদ্রিত, গ্রন্থিত 'য়ে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন অবয়বে, প্রচ্ছদের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে, পাঠকের ভুবনে এসে আলোর শিখা জ্বালাতে পারে পঠন-পাঠনের অপরিহার্য অঙ্গ হল পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাগার, গ্রন্থাগার ইত্যাদি পাঠ প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি শিক্ষানীতি আশ্চর্য, আন্তর্জাতিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও শিক্ষা, পাঠচর্চা, গ্রন্থ গ্রন্থশালার ইতিহাস কমবেশী রাজমহল ধর্মীয় অঙ্গনের সংবিধানে রচিত এবং বলা চলে একরূপ সর্বভারতীয় সাধারণ আঙ্গিক প্রচ্ছদে উপস্থাপিত পাবনা-টি, কালের প্রবাহে বাধা সেই বহু  রৈখিক লেখ বন্ধনেরই এক ক্ষুদ্র গ্রন্থি

পাবনাতে 'আজ 'তে শত বর্ষ আগে কি বই পড়েছে কারা কত অনুরাগে? জানতে বড় ইচ্ছে করে সে কথায় পরে আসি গত শতকের সীমান্তে দাঁড়িয়ে এমন জিজ্ঞাসা রাখলে কী জবাব পাওয়া যেতো? পাওয়া যেতো  শেকস্পীয়ারের কিম্ভুতকিমাকার ডাইনীদের ঢঙে উচ্চারিত একটা ইক্যুইভোকাল জবাবঃ সে কালের মানুষ বই পড়তো, আবার বই পড়তো- না অর্থাৎ সবলোক পড়তেন না পড়ার সুযোগ ছিল না বলে কিছু কিছু লোক পড়তেন যা পড়তেন তাকে বই যদি বলতেই হয় বলা উচিত 'পান্ডুলিপি বই তালপাতা, তুলোট কাগজে হাতে  লেখা পুথি কোরআন, হাদিস, পুরান, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, আরবী, ফার্সী, সংস্কৃত সবই হাতে লেখা একখানা থেকে অপরখানা নকল করা তাতে ভুল ভ্রান্তিও থাকতো লোকে পুথি নকল করা পুণ্যের কাজ বলে মনে করতেন এবং পেশাদার লিপিকরদের সম্মান দিতেন এরকম দুখানা তুলোট কাগজে লিপি 'পান্ডুলিপি বই অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে সংগৃহীত আছে যেমন লেখা তেমনি পড়াও জানতেন স্বল্প সংখ্যক লোক আর যারা জানতেন, সমাজে তাঁদের খ্যাতি-কদর ছিল জনপ্রিয় পুথি একজন পড়তেন আর বাকীরা চারপাশে বসে দরদ দিয়ে শুনে সাধ মেটাতেন পান্ডুলিপি বই ছিল মালিকের মূল্যবান প্রিয় সম্পদ অতি যতেœ তা সংরক্ষণ করতেন এবং কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতেন না পাবনায় ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের (Family archives)  এটাই প্রাথমিক পর্যায় উল্লেখযোগ্য পুথির খবরাখবর এলাকাবাসীর জানা থাকতো এবং অনুলিপি বা পঠন শ্রবণের প্রয়োজনে সংরক্ষণকারীর গৃহে সমঝদারের আনাগোনা চলত শ্রেণী বিন্যাসে পাবনার 'পান্ডুলিপি পুস্তক'গুলো ছিলো বেশির ভাগই সাধারণভাবে ধর্ম আশ্রয়ী তার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয়, রীতিনীতি, নিয়ম নির্দেশ সংক্রান্ত কিছু আধা ধর্মীয়, আর কিছু ছিল ধর্মীয় ঐতিহ্যভিত্তিক কল্পনা বিলাস ধর্ম নিরপেক্ষ পান্ডুলিপি পুথিসমূহ কাল্পনিক  কেচ্ছা, চিকিৎসা, হিসাব নিকাশের আর্যা শুভঙ্করী, ভাষা পরিচয় ইত্যাদি বিষয়ে লিপিকৃত হত

মধ্যযুগ ক্রান্তিকালের কোন কোন প্রখ্যাত হিন্দু মুসলমান কবিদের রচিত পান্ডুলিপির বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাবনার বনেদী হিন্দু মুসলমান পরিবারগুলো অবহিত ছিলেন বলে জানা যায় সে সব পা-ুলিপির অনুলিপি পাবনার এসব পরিবারের হাতে পড়েছিল কিনা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়

পাবনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে ছিল মুন্সী সাহেবের মক্তব, পন্ডিত মশায়ের পাঠশালা আর ভট্টাচার্যের  টোলচতুষ্পাঠী মক্তবের যে চমৎকার বর্ণনা মীর মশাররফ হোসেন, পাঠশালার শিবনাথ শাস্ত্রী এবং  টোলচতুস্পঠীর দিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এসবের সঙ্গে পাবনার সেকালের মক্তব পাঠশালা টোলচতুষ্পাঠীর অবস্থা চিত্র সম্পর্কে বংশ পরম্পরা সূত্রের ভিত্তিতে বয়ঃবৃদ্ধ হিন্দু মুসলমানের কাছ থেকে প্রাপ্ত বর্ণনার সামঞ্জস্য মেলে কায়স্থ ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্যেরা আসতেন যেমন বর্ধমান ইত্যাদি এলাকা থেকে; মুন্সী মৌলভী সাহেবরাতেমনি আসতেন  নোয়াখালী এলাকা থেকে জেলার খন্দকার বংশের উত্তরাধিকারীরাও মুন্সীর বিকল্প হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন চন্ডী -পে বা সম্পন্ন গৃহস্থের কাচারিতে বসত পাঠশালা, মসজিদ সংলগ্ন ঘরে অথবা অবস্থাপন্ন মুসলমান মাতব্বরের দহলিজে তেমনি বসত মক্তব কখনও কখনও পৃথক গৃহেরও ব্যবস্থা থাকতো কাব্য বিশারদ শাস্ত্রী ভট্টাচার্যিদের টোল চতুষ্পাঠী সাধারণত পৃথক অঙ্গনেই স্থাপিত হত পাঠ্য তালিকায় থাকতো আরবী, ফার্সী, সংস্কৃত, বাংলা বর্ণপরিচয়, বানান, ব্যাকরণ, শাস্ত্র ধর্ম বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান, শুভঙ্করী, হিসাব-নিকাশ, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ লিখন ইত্যাদি চতুষ্পাঠীতে স্মৃতি সংহিতা, শাস্ত্রজ্ঞান, কাব্য অলংকার ইত্যাদি শেখানো হত মাটিতে কাঠির সাহায্যে আঁক কাটা দিয়ে শুরু করে কলাপাতা, তালপাতার পরে কাগজে উত্তরণ অভিজাত পরিবারগুলোতে মেয়েদেরও বিশেষ ব্যবস্থায় পড়াশুনার সুযোগ ছিল খুব সম্ভব স্মৃতি শ্রুতি চর্চার উপর জোর পড়তো ছাত্রদের বই বলতে যা ছিল তা তো শুরু -িত ভট্টাচার্যের পা-ুলিপি বা স্মৃতির সংরক্ষণে পাবনার ওস্তাদ -িতদের সে মূল্যবান হাতে লেখা পুথি পুস্তকগুলো তাঁদের কালের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে মনে পড়ছে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার সেই প্রবাদ তুল্য উক্তিটি : Holland has books but no documents, Germany has both books and documents. পাবনাতে books ছিল, কিন্তু যুগটা কোন documents রেখে যায়নি

চার.

সম্ভব ছিল না উদ্ধৃতিতে বলেছিলাম, লিখিত কথা থাকে এবার সংশোধন করে বলি, লিখিত কথাও হারিয়ে যায়- মুদ্রিত কথা থাকে হল্যান্ডের দুর্দিন থেকে জার্মানির সুদিনে, হস্তলিখন থেকে মুদ্রণের স্তরে পৌঁছে মুদ্রিত পুস্তক হাতে পেতে পাবনাবাসীকে নিদেনপক্ষে গত শতকের তৃতীয় চতুর্থ দশক এবং আধুনিক শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করতে ৫ম/৬ষ্ঠ দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমাদের সনাতন জীবন বিধান পঠন- পাঠনের শহরমুখী পাশ্চাত্ত্যায়নের সোপান ধরেই পরিক্রমণের অগ্রাভিসার অবশ্য তার আগেই হুগলী ছাপাখানায় এবং শ্রীরামপুর মিশনে 'সাহেবদের ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং হুগলীর এন্ড্রুজ সাহেবের ঠাকুরের আশীর্বাদে বের হয়েছে হ্যালহেডের ফিরিঙ্গনা A Grammer of the Bengal language.""

বিস্তৃত বাঙলা উদাহরণসহ কোম্পানী বঙ্গের প্রথম মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক দেশে তখন কোন ডেনিস হে থাকলে আত্মহারা হয়ে বলে উঠতেন, 'Fail Lux': পৃথিবীতে আলো হোক কাঠের ব্লকে বাংলা লিপির বা রোমান হরফে বাংলা ভাষার মুদ্রণ-এর আগেও যে পাওয়া যায়নি তা নয় তবে দেশের মাটিতে তিনজন বিদেশি একজন পঞ্চানন কর্মকারের সমন্বিত প্রয়াসে এটাই প্রথম মুদ্রণ এবং পাঠ্য পুস্তক তবে পাবনাবাসীর জন্যে তা তো নয়ই, বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যেও নয়, ফিরিঙ্গি আমলাদের শিক্ষার্থে

পাঠ্য পুস্তকের এই শুরু তারপর কতিপয় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, শ্রীরামপুর মিশন স্কুল বুক সোসাইটির সক্রিয় ভূমিকায় ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এসে বাংলা মুদ্রণ আদি পর্বের সীমানা পেরোয় পর্বে বহু দেশিয় মুদ্রণালয় স্থাপিত হয়েছে কলকাতায় প্রকাশিত পাঠ্য পুস্তকের সংখ্যাও কম নয় তবে উইলিয়াম কলেজ শ্রীরামপুর মিশনারী প্রকাশনার দু'একখানা জনপ্রিয় বই বাদে বাংলা গদ্যের ইতিহাসে যতো মূল্যই বহন করে থাকুক না কেন, বৃহত্তর দেশিয় ছাত্র সমাজ পাঠকবর্গের সঙ্গে বাকীগুলোর সম্পর্ক তেমন নিবিড় ছিল না পঠন পাঠনের  ক্ষেত্রে পর্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ', হিন্দু মুসলমান সমাজের একাধিক সাময়িক সংবাদপত্রের প্রকাশ, প্রায় কাছাকাছি সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে এবং হিন্দু কলেজ স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠায় চারটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মূলত বাঙ্গালি বিদ্যানুরাগীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় পরিকল্পিত স্কুল বুক সোসাইটির বই সাময়িকপত্রের সংখ্যাগুলো বাঙ্গালি পরিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দান করল তবুকোনও পাঠশালায় মুদ্রিত কোন বই পড়ানো হয় না কোনও মতে বর্ণমালা, সংখ্যাপাঠও .... শিখিয়ে দেওয়া হয় রামায়ণ মহাভারতের যেসব পুথি পড়ানো হয় সেগুলো ভুলে বোঝাই, '১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে প্রদত্ত স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিবেদনে এবং ১৮৫৫ সালের প্রদত্ত লঙ সাহেবের অনুরূপ মন্তব্যে খোদ কলকাতার অবস্থা দৃষ্টে অন্তত পর্বের স্কুল পাঠ্য বইগুলো পাবনার ছাত্র বা পাঠক সমাজের হাতে আসার কথা ভাবাই যায় না তবে ব্যক্তিগতভাবে কোন জমিদার, সমঝদার পাঠকের মাধ্যমে রামমোহন পর্বের বই বা সাময়িকপত্রের সঙ্গে পাবনাবাসীর পরিচয় ঘটতে পারে বাংলা পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণের পরবর্তী পর্ব ১৮৩৫ থেকে শুরু 'য়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত পর্বের শুরুতেই বোধ করি মুদ্রিত পাঠ্য পুস্তকে পাবনাবাসীর পাশ্চাত্ত্য পঠন-পোঠন পাঠ নেয়া শুরু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ফার্সীর পরিবর্তে চালু হয় ইংরেজি তবু প্রথম পর্বের পাঠাভ্যাস এখন সুপ্রতিষ্ঠিত পর্বটি বিদ্যাসাগর, মদনমোহন অক্ষয় দত্তের ব্যক্তিত্বে লালিত 'য়ে চলতে থাকে বিকাশ বিবর্তনের পথে কলকাতাতেই বৃত্ত মুক্ত 'য়ে মুদ্রণ ব্যবহার পুস্তক প্রকাশনা ঢাকাসহ বিভিন্ন মফস্বল শহরে ব্যাপ্ত 'য়ে পড়ে প্রতিষ্ঠিত 'তে থাকে স্কুল কলেজ

এরই মধ্যে শিক্ষানীতি মেরু পরিবর্তন করে নেটিভদেরকে সনাতন প্রাচ্য শিক্ষার ঘুমপাড়ানী দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হবে, না পাশ্চাত্য শিক্ষার সূর্যপাত ঘটিয়ে জাগিয়ে দেয়া হবে, ছিল কোম্পানির জন্যে এক বিতর্কিত জিজ্ঞাসার মহাসংকট হেস্টিংস-উইলসন টোরি গোত্র সনাতন ধারারই পরিপোষণ করে যাচ্ছিলেন বিচারের এজলাসে ধর্মীয় আইন কানুনে অভিজ্ঞ মৌলভী -িত প্রয়োজন তাছাড়া নেটিভরাও সনাতনবাদী তাই কলকাতা, বেনারসে মাদ্রাসা সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হল, সরকারি বরাদ্দও নিয়োজিত ' প্রাচ্য বিদ্যার উন্নয়ন খাতে তাই ইংরেজ সিভিলিয়ান চার্লস গ্র্যান্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এদেশে ইংরেজি স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব 'রে প্রত্যাখাত হন ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে উইলবার ফোর্সও একই উদ্দেশ্যে ভারতে স্কুল মাস্টার পাঠানোর প্রস্তাব করলে তা নাকোচ করে দেয়া হয় পাছে নেটিভরা শিক্ষিত 'লে, আমেরিকার মতো ভারতকে না হারাতে হয় সময়ে পাশ্চাত্ত্য ইংরেজি শিক্ষা স্কুলের পিদিম জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন অবশ্যি সারবর্ণ হেয়ার, ডফ, মেয়ো ইত্যাদি পাদ্রী মিশনারিরা পরে এলো  বেন্টিং-মেকলে ট্রিভেলিয়ান এবং মেটকাফ উড়ডালহৌসীর মতো বৈপ্লবিক যুগ পুরুষদের জাগ্রত চেতনার বন্যাবেগ তাঁদের মতামত পদক্ষেপই এদেশে শিক্ষা সংস্কৃতি বোধের জগতে নবজাগরণ আনলো অবশ্য  দোশিয় হিন্দু-মুসলমান সংস্কারবাদী নেতৃবর্গের মনীষা দীপ্ত দূরদৃষ্টিই ছিল জনসমাজের ভবিষ্যতের দিক দিশারী পাশ্চাত্ত্য আদর্শে শিক্ষার নীতিমালা প্রণীত ' এবং নারী পুরুষের স্কুল কলেজ খোলার উদ্যোগই শুধু নেয়া হল না, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ' ফার্সীর ঐতিহ্য আচমকা মার খাওয়াতে মুসলমান সমাজের বৃত্তিগত জীবন পেল ক্রান্তিকালের ঝাঁকি সে ঝুল সামলাতে সামলাতে তাদেরকে কালের প্রতিযোগিতায় অনেকখানি পিছিয়ে পড়তে ' অতঃপর সিপাহী বিদ্রোহ নামে চিহ্নিত প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তছিটা নিয়ে  কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটলো রাণীর যুগের প্রারম্ভেই স্থাপিত ' জ্ঞানের মাইলস্টোন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম গ্রাজুয়েট সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এবং মুসলমান সমাজের স্মরণীয় নাম দেলোয়ার হোসেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, আমীর আলী, আবদুল লতিফ, দেলোয়ার হোসেন খান প্রমুখ সচেতন পুরুষ সিংহদের দিক নির্দেশনায় মুসলিম সাংবাদিক সাহিত্যিকদের ভূমিকায় মুসলমান সমাজও দ্বৈধতা কাটিয়ে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণ করতে স্থিতধী হয়ে উঠতে থাকে পাবনায় 'বছর পাটের ফলন বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের হাতে পয়সা এলো অধ্যায়টিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় পাবনা জেলা স্কুল জেলা স্কুলকে অনুসরণ করেই বর্তমান পাবনা শহর মফস্বল অঞ্চলের নদীবন্দর ব্যবসাকেন্দ্রগুলোতে বেসরকারি উদ্যোগে ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় জি. সি. আই, আর. এম. একাডেমি, বেড়া বি. বি. হাইস্কুল ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উনিশ শতকের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে এবং উনিশের অন্তিম প্রহরে, ১৮৯৮ সালে, প্রতিষ্ঠিত ' শতাব্দীর সাক্ষী এডওয়ার্ড কলেজ এর পর বিশ শতকের ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠিত 'তে থাকে অন্যান্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা

আগের পাশ কাটানো প্রশ্নটাতে আবার ফিরে যাই উনিশ শতকের ৯০-এর পাবনায় কি বই পড়েছেন পাবনাবাসী? বিদ্যাসাগর-মদনমোহন-অক্ষয়বাবু- ঈশ্বরগুপ্তকে তাঁরা গোটাই পেয়েছেন পেয়েছেন মাইকেল-দীনবন্ধু- টেকচাদ-বঙ্কিম-মশারফ হোসেনকে ধ্যানমগ্ন বিহারী লালের ঢুলুঢুলু কীর্তন শূনে তাঁরা এখন রাবীন্দ্রিক বলয়ে উপস্থিত, সবেমাত্র তিনি 'মানসী', 'বিসর্জন' শেষ করলেন ভাগ্যবঞ্চিতা অবোধ রতনের স্বার্থপর দাদাবাবুকে নিয়ে এখন 'পোস্টমাস্টার' লিখতে বসেছেন এরপর রবি জ্বলতে জ্বলতে উঠতে থাকবে, ছড়াতে থাকবে ভুবনে ভুবনে আসবেন শরৎ, নজরুল, সত্যেন, জসীম, তিরিশোত্তর ঋতু রীতিবদলের কবিকূল আসার কি শেষ আছে? পাবনার পাঠকবর্গের চোখে তাই অযুত প্রত্যাশা আর শুধুই কি সাহিত্য? জ্ঞানের বিচিত্র পথ আজ পাবনার  চৌমাথায় এসে ভিড় জমিয়েছে তখন 'সংবাদ প্রভাকর', 'সমাচার সভা রাজেন্দ্র', 'জগদ উদ্দীপক ভাস্কর', 'বঙ্গ দর্শন', 'ভারতী' সাধনার অনুজ 'হিতকরীর জন্ম হয়েছে নিজেরাও প্রকাশ করেছেন স্থানীয় প্রেস থেকে 'পাবনা দর্পণ, /৬৫, 'স্বদেশ হিতৈষিণী/৭৫, ‘জ্ঞান বিকাশিনী', 'বার্ত্তা বাহক'/৮২, প্রকাশ রেছেন 'আরতি, 'ঊষা', 'বিজ্ঞান প্রদীপ আরও কত পত্রিকা

কত বই কত পত্র পত্রিকা চারপাশে আরো চাই, আরো চাই এত বই কোথায় রাখি? বই তাঁরা রাখতে চান পারিবারিক সংগ্রহে কিন্তু সকলের জন্যে তো চাই একটি গৃহ, একটি অঙ্গন, একটি গ্রন্থাগার- একটি পাঠাগার 'অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি' কি তখন পাবনার একমাত্র গ্রন্থাগার? এটা তো শহরের একটা জেলার আর  কোথাও কি গ্রন্থাগার থাকতে পারে না? তখনকার পাবনার অন্য কোথা, অন্য কোনখানেও কি গ্রন্থাগার ছিল না?  কে বলবে? বিশ্ব গ্রন্থালয়ের ইতিহাসে দেখা যায় ধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র, রাজদপ্তর, ব্যবসা বাণিজ্যিক নীতি, জোত জমির দলিলপত্র, কুলচিনামা ইত্যাদিকে আশ্রয় করেই ধীরে ধীরে গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছে পুরাকালে ধর্ম, শিক্ষা এবং কখনও রাজদরবার পরস্পর ঘনিষ্ঠ ছিল মেসোপটেমিয়া কাপাদোকিয়া মিশর, ভারতের নালন্দা, তক্ষশিলা ইত্যাদি এলাকার গ্রন্থাগারের সংগঠন অনেকটা এই আঙ্গিকের 'অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি পত্তনের কালে তাঁতিবন্দ, তাড়াশ, বনওয়ারী নগর, চাটমোহর ইত্যাদি জমিদারী জোতদারী সেরেস্তায় শুধু দলিল দস্তাবেজ নয়, উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের এবং পত্র পত্রিকারও সংগ্রহ ছিল বাবু কর্মচারিরা তো পড়তেনই সাধারণ পাঠকও বই ধার নিতে পারতেন পুরাকীর্তির পাবনায় মন্দির পুরোহিতদের -িম-পে ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠীতে পান্ডুলিপি পুস্তিকা  থেকে ধর্ম সংক্রান্ত ছাপা বই পত্রও সংরক্ষিত থাকতো অনুমান, বর্ধিষ্ণু কোন কোন গঞ্জ, বন্দর যেমন সাতবাড়িয়া, সুজানগর, বেড়া, চাটমোহর, বনওয়ারী নগরেও হয়তো ছোটখাট সংগ্রহশালা গড়ে উঠে থাকবে ১৯৪৭-এর পর পাবনার পঠন-পাঠন গ্রন্থ সংগ্রহের পরিম-লে পুরনো ঐতিহ্যের কিছুটা সংক্রান্তি নামে পাবনার রুচি, অভাস, পাঠস্পৃহা বদান্যতা সংগৃহীত বই পুস্তক বৈদ্য নিয়ে অনেকেই ভারতে চলে যান নোতুন প্রজন্মের ঐতিহ্য গড়ে উঠতে থাকে পাকিস্তানি উপনিবেশের প্রতিকূল পরিবেশে একাত্তরের পর স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে পাবনা আজ পরিণত পাঠক তার শিক্ষার প্রসার জিজ্ঞাসার অসীমতা, প্রজ্ঞার প্রত্যয়, সংস্কৃতির বাহু বিস্তার পঠন-পাঠনের দিগন্তে এক আদিগন্ত প্রার্থনাঃ পড়তে চাই, পড়তে চাই এবং পড়তে চাই প্রভু বাড়িয়ে দাও আমাদের জ্ঞানের ভুবন 

[বি: দ্র : অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, পাবনা-এর শতবর্ষ স্মরণিকা ১৯৯০ থেকে লেখাটি সংকলিত]

 


0 Comments: