[ রচনাটি সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এর প্রথম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, তারিখ ১৪ মার্চ ২০২৪-এ প্রকাশ হয়েছিল ]
পাবনা জেলার সাহিত্য
সাধনা প্রসঙ্গ : মুক্তিযুদ্ধ
প্রফেসর কামরুজ্জামান
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর পাবনা জেলার একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। পাবনা শহরের দামাল ছেলেরা ২৩ মার্চ শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করেছিল। পুরনো টেলিফোন ভবন প্রাঙ্গণে ২৮ মার্চ সংঘটিত রাইফেল-যুদ্ধে পাক সেনাদের নিধন করে পাবনার দামাল ছেলেরা। পাবনা সদরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল হয় শত্রুমুক্ত এবং আসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থা কায়েম ছিল ১০ এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক পাকসেনা ভারি অস্ত্র-শস্ত্র ও প্লেন থেকে গোলাবর্ষণের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়ন করার আগ পর্যন্ত।
গৌরবদীপ্ত সংগ্রামী জনতা দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনে বীর শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগ্রামী জনতার অবদান সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। আর সেই স্মরণের বহিঃপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনাবলী ।
মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন আর শিল্পী সাহিত্যিকরা যুদ্ধ করেছেন মসি দিয়ে। পাবনা জেলার অনেক লেখকের রচনায় ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-এর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। Ôকফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই গানে কোন মোর ইন্দ্রধনু’ ইত্যাদি গান রচনায় খ্যাত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু গান লিখেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর এক উল্লেখ্য সৃষ্টি Ôশোন একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিখ্যাত উপন্যাস Ôরাইফেল রোটি আওরাত’। কথা সাহিত্যের ধারায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এর রচয়িতা আনোয়ার পাশা। লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিক্রান্ত করেছেন পাবনায়। পাবনায় মানস গঠিত হওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁকে এ জেলার লেখক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি এ উপন্যাস রচনা করেছেন। এর পান্ডুলিপি কিংবা তার অংশবিশেষ তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর নজরে পড়লে লেখক এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের সমুহ বিপদ হতে পারতো। তারপরেও তিনি লিখেছেন। কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গানের কলি প্রসঙ্গত: স্মর্তব্য- Ôআমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’। মনের দিক থেকে অনুভব করেছেন কিছু একটা লেখা দরকার। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। স্বাধীনতার প্রাক্ -লগ্নে তিনি শহীদ হন।
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ খ্যাত কবি ওমর আলীর বিভিন্ন কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতার অন্যতম উল্লেখ্য বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। ‘তোমাকে দেখলেই’ কাব্যের একাধিক কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ লক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় প্রয়াস- ‘আমি ষোলই ডিসেম্বর’ Ôষোলই ডিসেম্বরে এসে’ Ôবিজয়ের আনন্দ উল্লাসে বিজয় আর কত দূরে’।
পাবনা জেলার বিশিষ্ট লেখিকা সাঈদা খানম ছোটগল্প রচনায় খ্যাতিমান। সাহিত্যের পাশাপাশি আলোকচিত্রে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মহিলাদের তাঁকে পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে তাঁর আলোকচিত্রের ওপর প্রদর্শনী হয়েছে। এতে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাঙালির অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের স্মারকচিহ্ন যেমন রয়েছে, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিহ্ন।
পাবনা জেলার বিশিষ্ট কথাকার রশীদ হায়দার। তাঁর অন্যতম উল্লেখ্য সৃষ্টি Ôখাঁচায়’। এ উপন্যাসে লেখক দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত করেছেন অধিকৃত আমলের কথা। মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এছাড়া তাঁর বেশ কিছু ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ লক্ষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ওপর রশীদ হায়দার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘স্মৃতিঃ ১৯৭১’ ১ম খ- প্রকাশকাল ১৯৮৮। পরের বছর বের হয় ‘স্মৃতিঃ ১৯৭১ (২য়খ- খন্ড) । Ôস্মৃতিঃ ১৯৭১ (৩য় খন্ড)গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৯১।
সাঈদ হাসান দারা এ জেলার একজন কৃতি কথাশিল্পী। তাঁর স্মরণীয় প্রয়াস- Ôঅপারেশন সার্চলাইট-১৯৭১’ Ôসাত বীরশ্রেষ্ঠ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও তিনি লিখেছেন।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল-এর একটি উল্লেখ্য প্রবন্ধ Ôসংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধার স্রষ্টা পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক সংখ্যায় মুদ্রিত। অকালে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রয়াত এই বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, ও পাবনায় প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারীর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ এই প্রবন্ধ ।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মো. জহুরুল ইসলাম বিশু মুক্তিযুদ্ধের ওপর গ্রন্থ লিখেছেন । তাঁর গ্রন্থের নাম Ôপাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’। সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত। লেখক নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি আহত হন। যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থ সম্পর্কে ভূমিকায় এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীর উত্তম লিখেছেন- Ôদূর্ভাগ্যবশতঃ পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস রচিত না হওয়ার কারণে অনেক বীরত্বগাঁথা অজ্ঞাত থেকে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বিশু রচিত Ôপাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’ গ্রন্থ এই অভাব কিছুটা মেটাতে পারবে আশা রাখি। এ বইয়ের কাহিনীগুলো মূলত লেখকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত।”
জহুরুল ইসলাম বিশু রচিত গ্রন্থটির ইংরেজি ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে। এটিও প্রকাশ করেছেন ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশ। অনুবাদ করেছেন দুলাল আল মনসুর।
অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ মুক্তিযুদ্ধের ওপর একাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান Ôবাংলাদেশের স্বাধীনতা: যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ’ ‘বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ’।
একাত্তরের বিসবতীর্ণ পটভূমি থেকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিবারের জীবনকথা নিয়ে প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন নাসরিন নিহার। এ গ্রন্থের নাম- Ôজীবনের মানচিত্রে ৭১’। ‘স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন রবিউল ইসলাম রবি। লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এ গ্রন্থ সমৃদ্ধ। পাবনা জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত Ôডিজিটাল বাংলাদেশ-দিন বদলের অগ্রযাত্রায় পাবনা’ স্মারক সংখ্যায় (ফেব্রু ২০১৩) Ôস্বাধীকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলা’ নামে প্রবন্ধ লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ডক্টর এম আবদুল আলীম। তথ্যসমৃদ্ধ, গবেষণামূলক মূল্যবান প্রবন্ধ। ২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভক্ষণে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন পরিষদ, পাবনা থেকে মানিক মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়েছে Ôআলোর পথযাত্রী’। মহান বিজয় দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম রাঙা প্রকাশ করেছেন ‘পাবনার ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ গ্রন্থ থেকে আগামীকালের গবেষক, যারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাজ করবেন, তারা বিপুলভাবে উপকৃত হবেন।
পাবনা জেলা থেকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন বা স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে মুদ্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ। এ জাতীয় স্মরণিকার মধ্যে শফিকুল ইসলাম শিবলী সম্পাদিত ÔআবেসীÔ, নাজমূল আলম সম্পাদিত ‘বাংলা আমার বাংলা’, বাংলাদেশ কবিতা সংসদ, পাবনার মুখপত্র মানিক মজুমদার সম্পাদিত Ôখোলাচোখ’, শাকিব লোহানী বুলবুল সম্পাদিত Ôরক্তে এলো স্বাধীনতা’ ও গোলাম হাফিজ সম্পাদিত Ôকলম সৈনিক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জেলা প্রশাসন, পাবনার পক্ষ থেকে বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক স্মরণিকা, স্মারক সংখ্যা। এর মধ্যে ২০০৬-এ প্রকাশিত Ôবিজয়ের অশ্রু’ এবং ২০০৭-এ মুদ্রিত Ôবিজয়ের চেতনা’ উল্লেখযোগ্য। বিজয় দিবস উপলক্ষে জেলা পরিষদও একাধিক স্মরণিকা বের করেছেন। মীর্জা গোলাম রব্বানীর ব্যক্তিগত একাধিক উদ্যোগে একাধিক স্মারক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রয়াস অভিনন্দনযোগ্য।
পাবনা জেলার লেখকদের রচনায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে এসেছে। শিল্পীরা তাঁদের কথা কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। এঁদের মধ্যে ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, জয়নাল আবেদিন মাহবুব, আবুল কাসেম, ফজলে খোদা, মাকিদ হায়দার, আলাউদ্দিন মোল্লা, আমিরুল ইসলাম রাঙা, আবুল হোসেন খোকন, রবিউল ইসলাম রবি, শেখ মোহাম্মদ মজনুর রহমান, হাসান আহমেদ চিশতি, আখতার জামান, আশরাফ পিণ্টু, হাবিবুর রহমান স্বপন, আজাদ এহতেশাম, শফিকুল ইসলাম শিবলী, শুচি সৈয়দ, মোস্তাফা সতেজ, আবু মহম্মদ রইস, মজিদ মাহমুদ, আতাহার আলি, মানিক মজুমদার, মো. আবুল কালাম আজাদ বাবু, ফাহমিদা হোসেন মিনু, সৈয়দা জহুরা আকতার ইরা, দেওয়ান ওহিদুজ্জামান বাদল, আদ্যনাথ ঘোষ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।
আমাদের সময়ের এক বিরাট ঘটনা এই মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার জন্য এত আত্মত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। মুক্তিযুদ্ধে কত মায়ের কোল যে শূন্য হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । এই সব শহীদেরা চিরঞ্জীব, তাদের মৃত্যু নেই। তারা চিরকাল জাগরুক থাকবে আমাদের অন্তরের মণিকোঠায়। গীতিকারের ভাষায় ‘তারা এ দেশের ধানের শীষে, চিরদিন আছে মিশে’। এই সব শহীদের কাছে আমাদের ঋণের পরিমান অপিরেমেয়। এঁদের কথা নিয়ে আমাদের লেখকেরা লিখছেন। আগামীতেও এর ওপর অনেক কিছু লেখা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর মহত্তম রচনা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় আমরা অপেক্ষমান ।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচনার তালিকা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা দুরূহ। অনেক কথা অনুক্ত রয়ে গেল। আর তাছাড়া এ প্রবন্ধের বাইরে যে তথ্য লভ্য তা আগামীকালের গবেষকদের হাতে রইল ।
তথ্য সূত্র: ১। দ্রঃ ভূমিকা, Ôপাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’। মো. জহুরুল ইসলাম বিশু
২। পূর্বোক্ত, ৩। Ôবিজয়ের চেতনা’, জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকা।
কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ পাবনা জেলার সাহিত্য সাধনা প্রসঙ্গ : মুক্তিযুদ্ধ
0 Comments: